বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; গুরুদত্ত সিং লিখিত বই তোমাকে ভালোবাসি হে নবী এর pdf ফাইল ডাউনলোড করতে নিচে দেওয়া DOWNLOAD বাটনে ক্লিক করুন।
‘সীরাতুন্নবী’ – হৃদয়ের নিভৃতলোকে আশ্চর্য স্নিগ্ধ এক অনুভূতি জাগ্রত করে ছোট্ট এ শব্দটি। জীবনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞান এবং পথ ও পাথেয় লাভের ‘আলোক-উৎস’ হলো সীরাতুন্নবী। তাই – আল্লাহর শোকর – জীবনের শুরু থেকে ‘সীরাতুন্নবী’ ছিলো আমার অধ্যয়নের অন্যতম প্রিয় বিষয়। নানাজান মাওলানা আব্দুল জলীল মাযাহেরী (রহঃ) রচিত ‘ছোটদের নূরনবী’ দ্বারা আমার সীরাত অধ্যয়নের শুভ সূচনা। তখন থেকে এখন– এ দীর্ঘ জীবন, বাংলা, উর্দূ ও আরবী ভাষার সীরাত ভাণ্ডার থেকে আমি যথাসম্ভব ‘আলো’ অর্জনের চেষ্টা করে আসছি। তবে তা সীমাবদ্ধ ছিলো মুসলিম মনীষীদের কলম পর্যন্ত। কোন অমুসলিম মনীষীর লেখা সীরাত-গ্রন্থ পড়ার সুযোগ আমার কেন যেন কখনো হয়নি।
কয়েক বছর আগে নূরিয়া মাদরাসার কুতুবখানায় ‘রাসূলে আরাবী’ নামে উর্দূ ভাষায় রচিত ছোট্ট কলেবরের একটি কিতাব দেখতে পেলাম। এবং আগ্রহভরে হাতে নিলাম, লেখকের নাম গুরুদত্ত সিং! প্রথম পৃষ্ঠায় পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে- ‘ইসলামের নবীর প্রতি অনুরাগী’ একজন শিখ গুরুদত্ত সিং-এর কলমে রচিত’।
কৌতুহলী মনে পাতা উল্টে দেখি, আমার জন্য অপেক্ষা করছে! আরেকটি বিস্ময়! জগদ্ববরেণ্য আলিম ও সীরাত গবেষক আল্লামা সৈয়দ সোলায়মান নদভী (রহঃ) বইটি সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ প্রশংসা-মন্তব্য লিখেছেন। ফলে আমার হৃদয়ে গ্রন্থ ও গ্রন্থকার সম্পর্কে একটি ‘কোমল অনুভূতি’ সৃষ্টি হলো। কিতাবটি পড়লাম। একবার, দু’বার এবং কয়েকবার। এক কথায় ‘অপূর্ব’! যেমন ভক্তি ভালোবাসার আবেগ-উচ্ছ্বাস, তেমনি ভাষা ও সাহিত্যের ছন্দময় প্রকাশ! হৃদয়ের উৎস থেকে নবী-প্রেমের একটি ঝর্ণাধারা যেন কল্লোল ধ্বনি তুলে বয়ে চলেছে। ভাবের তরঙ্গে, আবেগের উচ্ছ্বাসে, শব্দের সুরঝংকারে এবং ভাষার নৃত্য ছন্দে আমিও যেন দোল খেতে খেতে এগিয়ে চলেছি। আমারও হৃদয়ে নতুন করে নবী-প্রেম উথলে উঠেছে। যতবার পড়েছি ততবার আমি ‘দুই নয়নের জলে’ সিক্ত হয়েছি এবং লজ্জিত মনে বারবার ভেবেছি, ‘পর’ যদি আমাদের নবীকে এমন করে ভালোবাসতে পারে, এমনভাবে ভক্তি-শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করতে পারে তাহলে ‘আপন’ যারা, তাদের কেমন হওয়ার কথা ছিলো, অথচ তারা কেমন হয়েছে!
একদিন এক ঘরোয়া ‘সাহিত্য জলসায় এক বন্ধু বললেন, বইটি বাংলাভাষায় অনুবাদ করে বাংলাদেশের কোটি কোটি ‘ভক্ত’ ও কতিপয় ‘বিরক্ত’- উভয় শ্রেণীর পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারলে ভালো হয়। তাতে কোটি কোটি নবী-ভক্ত পাঠক নবী- -প্রেমের একটি নতুন সৌন্দর্যে অবগাহন করার সুযোগ পেয়ে ধন্য হবেন। আর রহমতের নবীর প্রতি কতিপয় ‘বিরক্ত’ যারা, তাদের মন-মগজের সব জঞ্জাল একজন অমুসলিমের হৃদয় থেকে উৎসারিত নবীপ্রেমের স্রোত ধারায় ভেসে যাবে এবং আল্লাহর ইচ্ছা হলে তারা পরিশুদ্ধ হওয়ারও সুযোগ পাবে।
কথাটি আমার মনে দাগ কাটলো এবং আল্লাহ রাহমানুর রাহীমের উপর ভরসা করে এক সময় আমি বইটির অনুবাদ শুরু করলাম। ধারণা ছিলো, বইটির অনুবাদ খুব সহজ হবে না। বাস্তবে দেখা গেলো, কাজটি আমার ধারণার চেয়েও কঠিন। কেননা লেখকের ভাব ও আবেগের উচ্ছ্বাস এত প্রবল, ভাষা ও বক্তব্যের গতি এত উচ্ছল এবং উপমা ও শব্দ প্রয়োগের কুশলতা এত চমৎকার যে, আমার হাতের দুর্বল কলমের পক্ষে সেই ‘বেগ ও আবেগ’ এবং সেই ‘গতি ও ছন্দের’ ভাষান্তর মনে হয়েছে প্রায় অসম্ভব।
তদুপরি একজন অমুসলিমের চিন্তা-চেতনা, ভাব ও ভাবনা এবং ভক্তি-ভালোবাসার নিজস্ব প্রকাশ অক্ষত রাখা ও বেশ কঠিন, অথচ ‘সাহিত্য-সততার’ জন্য তা অতীব জরুরী। তবে এতটুকু বলতে পারি যে, সাধ্যের সীমানায় আমি চেষ্টা করেছি এবং আল্লাহর রহমতে হয়ত কিঞ্চিৎ সফলতাও এসেছে। যে উদ্দেশ্যে বইটি অনুবাদ করা, তা যদি কিছুমাত্র অর্জিত হয়, সর্বোপরি আল্লাহ মেহেরবান যদি কবুল করেন তবেই আমার শ্রম সার্থক হবে। আমার কামনা, এ লেখা যেন রোয হাশরে আমাকে ‘আলো’ দান করে এবং হাউযে কাউছারের পথ চিনিয়ে দেয়।
বইটি সম্পর্কে আল্লামা সৈয়দ সোলায়মান নদভী (রহঃ) -এর মত ব্যক্তিত্বের একটি মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সৈয়দ ছাহেবের মনে হয়েছে, লেখকের কলমের প্রতিটি শব্দ থেকে নবীপ্রেমের ‘আবে কাউছার’ যেন ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে। ‘আবে কাউছারের’ সেই ‘বিন্দুপতন’-এর যে স্বাদ ও সৌন্দর্য এবং যে সুর-মাধুর্য, বাংলা অনুবাদে সেটাই আমি ধরে রাখার চেষ্টা করেছি এবং এই ধরে রাখার প্রয়োজনে অনিবার্য কিছু পরিবর্তন ও পরিমার্জন করেছি। উর্দু-ফারসী কবিতাগুলো বক্তব্যের গতিময়তা অব্যাহত রাখার জন্য বাদ দেয়া হয়েছে।
তাছাড়া উচ্ছ্বাস-প্রবলতায় বক্তব্যের বিন্যাস কাঠামো মাঝে মধ্যেই কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই ক্ষেত্রবিশেষে বিন্যাস-কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কারও আমাকে করতে হয়েছে, তবে লেখকের বক্তব্য এবং ভাব ও আবেগ অক্ষুণ্ণ রাখার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়েছে। যারা উর্দূ জানেন তাদের বোঝার সুবিধার জন্য লেখকের ভূমিকার অংশবিশেষ নমুনা রূপে তুলে দেয়া হলো। মূল ও অনুবাদ মিলিয়ে দেখলেই বিষয়টি তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন।
অনুবাদের পাণ্ডুলিপি দীর্ঘ দিন অপ্রকাশিত অবস্থায় পড়েছিলো এবং আটাশির প্রলয়ংকরী বন্যায় ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমার স্নেহভাজন ছাত্র মাওলানা সাখাওয়াত তাদের প্রকাশনা সংস্থা ‘দারুল কাউছার’ থেকে বইটি প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করায় ১৯৯৮-এ তা আলোর মুখ দেখতে পেয়েছে। সে জন্য আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তাদের সকলকে খায়রুল জাযা দান করুন। দীর্ঘ দিন ‘বইমহলে’ বইটি অনুপস্থিত ছিলো এবং পাঠকমহল থেকে জোর অব্যাহত ছিলো, তাই প্রয়োজনীয় পরিমার্জন ও ‘সোভাবর্ধনের’ পর ‘দারুল কলম’ থেকে এখন এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে। প্রথম সংস্করণের মত এবারও প্রচ্ছদ শিল্পী আমার প্রিয় ভাই মাওলানা বশির মিছবাহ। তার আঁকা প্রচ্ছদের সাজে আমার কোন বই যখন আত্মপ্রকাশ করে তখন আমি তৃপ্তিবোধ করি। আল্লাহ তার ‘নেক আরজু’ পূর্ণ করুন।
দ্বিতীয় সংস্করণের অক্ষর বিন্যাস ও সার্বিক অঙ্গসজ্জার ক্ষেত্রে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে শ্রম দিয়েছে আমার স্নেহের ভাই মাওলানা হাসান মিছবাহ। এ বিষয়ে তার গতি ও দ্রুততা প্রশংসনীয়। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
আটাশির বন্যায় অনুবাদের পাণ্ডুলিপি রক্ষা পেলেও মূল বইটি সেই যে হারিয়ে গেলো, আর পাওয়া গেলো না। ফলে প্রথম সংস্করণে আল্লামা সৈয়দ সোলায়মান নদভী (রহঃ)-এর মন্তব্য সংযুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
অনেক পরে আমার প্রিয়তম ছাত্রদের একজন মাওলানা হাবীবুর রহমান নদভী-এর মাধ্যমে জানতে পারি যে, বইটির একটি দুর্লভ কপি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা লৌখনো-এর কতুবখানায় সংরক্ষিত আছে। তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বইটির ফটোকপি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। আল্লাহ তাকে সর্বোচ্চ জাযা দান করুন। তার ও ‘তাদের’ সম্পর্কে আমি যে স্বপ্ন দেখি, আল্লাহ তা বাস্তব করুন। জীবনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যে সাধনা ও ‘সাহারুল-লায়ালি’ -এর প্রয়োজন, আল্লাহ আমাকে এবং তাদেরকে সে তাওফীক দান করুন। আমীন!
প্রিয় পাঠক! অনেক বিরক্ত করা হলো, এবার আমি যাই। আপনি প্রবেশ করুন ‘সীরাত উদ্যানের’ একটি নতুন অঙ্গনে, নবী-প্রেমে ‘স্নাত’ একজন ‘অমুসলিম’ তার হৃদয়ের সুরভি মেখে যেখানে সৃষ্টি করেছেন একটি অনবদ্য ফুল, যার নাম ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’!
প্রিয় পাঠক! আরেকটি কথা না বলে পারি না। ‘তোমাকে ভালোবাসি হে নবী’ এর প্রথম পাঠক ছিলেন আমার আম্মা-আব্বা। মাথার উপর এখনো আল্লাহ আম্মার ছায়া রেখেছেন, কিন্তু আব্বার ছায়া উঠে গেছে। ‘শরীরী জীবনের’ মত আমার ইলমী জীবনেরও প্রতিটি অণুপরমাণু তাঁর ত্যাগ ও আত্মত্যাগের কাছে চিরঋণী। আমাকে গড়ার জন্য নিজেকে তিনি তিলে তিলে ক্ষয় করেছেন। অবশেষে বিগত ১৭ই মুহররম রাত আটটা ত্রিশ মিনিটে তিনি ইনতিকাল করেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।) আমার অক্ষম হৃদয়ের প্রার্থনা, আল্লাহ যেন তাঁকে পূর্ণ শান্তিতে রাখেন, আর এ প্রার্থনায় যারা ‘আমীন’ বলে, আল্লাহ যেন তাদেরও উত্তম বিনিময় দান করেন। আমিন!