সানজাক ই উসমান pdf: ১১৬২ সাল, বসন্ত কাল। পবিত্র পর্বত বুরখান খালদুনের ঢালে ওনােন নদীর তীরে নিজের দুই স্ত্রী সােচিদেই আর হুয়েলােনকে নিয়ে বেশ আমােদ করে বেড়াচ্ছিলেন বােরজিগিন গােত্রের ইয়ুসুগেই। দুই শ্রীর মধ্যে বড়জন সােচিদেই তার চেয়ে কয়েক বছরের বড়।
কিন্তু সােচিদেই তার প্রধান শ্রী নন, সে জায়গাটা রাখা তার ছােট স্ত্রী হুয়েলােনের জন্য। হালকা পাতলা গড়ন আর লম্বা চুলের এই মেয়েটিকে ইয়ুসুগেই লুট করে এনেছেন মেরকিতদের কাছ থেকে। তারপর তাকে করে নিয়েছেন নিজের প্রধান স্ত্রী।
পাহাড় থেকে নেমে নদী তীরে কিছুক্ষণ চরে বেড়ানাের পর হঠাৎ ইয়েলােন ঘােড়া থেকে নেমে পড়ল। নিজের পেট চেপে ধরে বসে পড়ল মাটিতে শুরু হলাে চিৎকার।
ইয়সুগেই প্রথমে না বুঝলেও সােচিদেই ঠিকই বুঝেন্থেন তার সতিনের প্রসব বেদনা উঠেছে। তাকে নিয়ে যাওয়া হলাে একটা ঝােপের ভেতর। কয়েক মিনিটের ভেতরেই এক সুস্থ সবল শিশুপুত্রের জন্ম দিল হুয়েলােন ছেলেটির চোখজোড়া হলুদ, ডান হাতের মুঠোতে জমাট বেঁধে আছে এক টুকরাে লাল রক্ত। আকাশের দিকে তাকিয়ে মহান তেংরিকে কৃতজ্ঞতা জানালেন ইয়ুসুগেই। হাতের মুঠোয় জমাট রক্ত নিয়ে জন্মানোর মানে এই ছেলে একদিন মহাবীর হবে।
সানজাক ই উসমান pdf
বরফের ওপর কিছুক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম শেষে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাঁটা ধরলেন হুয়েলোন। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই উঠে পড়লেন নিজের ঘোড়ায়। তিনি ওলখানি গোত্রের মেয়ে। তার গোত্রের মেয়েদের ঘোড়া থেকে নেমে বাচ্চা প্রসব করে ঘোড়ায় উঠে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না। ইয়ুসুগেই ঠিক করলেন তার সন্তানের নাম রাখা হবে তেমুজিন।
ইয়েসুগেই মানুষটা সাধারণ হলেও তার বংশপরিচয় সাধারণ ছিল না। তার দাদা খাবুল ছিলেন খামাগ মোঙ্গলদের খান। তার বংশধারা গিয়ে মিলিত হয়েছে মহাবীর বুদুনচার মুনখাগের সাথে।
কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দীতে চীনের জিন রাজবংশের অত্যাচারে তাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন। খাবুল খানের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তা দিয়ে দেয়া হয়েছিল তাতারদের হাতে। জিনদের শক্তি ছিল অপরিমেয় তাই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনো চেষ্টাই করেনি মোঙ্গলরা। ইয়ুসুগেই চেষ্টা করছিলেন নিজের গোত্রকে আবার ঐক্যবদ্ধ করতে। কিন্তু তাতাররা আর সেটা হতে দিল না। মূলত শক্তি বাড়ানোর জন্যই ইয়ুসুগেই বড় ছেলে তেমুজিনকে ঐঙ্গিরাত গোত্রের মেয়ে বর্তির সাথে।
মোঙ্গল প্রথা অনুযায়ী যারা মেয়ে দেয় তারা হলো উঁচু, আর নিচু। তাই ছেলের পরিবার মেয়ের পরিবারকে যৌতুক একটা কালো স্যাবলের চামড়ার জ্যাকেট। বাবার অনুযায়ী বর্তির বাড়িতেই থেকেছেন তিন বছর। ইতোমধ্যে তাতাররা একদিন বিয়ে বাড়ির খাবারে বিষ দিয়ে হত্যা করে ইয়ুসুগেইকে। বাবা হারানোর খবর পেয়ে বালক তেমুজিন বাধ্য হলো মায়ের কাছে ফিরে যেতে। ইয়ুসুগেইয়ের মৃত্যুর পর পরই গোত্রের শক্তিশালী প্রতিপক্ষরা নির্বাসনে পাঠায় তেমুজিন ও তার পরিবারকে। বনে জঙ্গলে তীব্র কষ্টের ভেতর বড় হতে থাকল তেমুজিন।
সানজাক ই উসমান pdf free download
তাদের খাবার ছিল শিকার থেকে পাওয়া খরগােশ, হাঁস আর ঘুঘুর মাংস। কিন্তু রােজ রােজ শিকার মিলত না। তিন ভাই, দুই সত্তাই আর এক বােন ও মাকে নিয়ে জঙ্গলে টিকে থাকা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর ও চ্যালেঞ্জের। এমন অনেক দিন গেছে, নেকড়ের খাওয়া মরা ষাঁড়ের মাংস খেয়ে টিকে থেকেছে তার পরিবার। এই কষ্ট আরও তীব্র হয়ে উঠে যখন তার এক সভাই বারগাত জোর করে তার মা হুয়েলােনকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে। নিজের ভাইদের মধ্যে তেমুজিন আর খাসার তখন বালক মাত্র। চোখের সামনে সভাইয়ের হাতে প্রতি রাতে মাকে ধর্ষিতা হতে দেখার তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করে দিনকে দিন লােহার মতাে কঠিন হয়ে যেতে থাকে তেমুজিনের মন। একদিন শিকারের ভাগাভাগি নিয়ে হওয়া তুচ্ছ মারামারিতে সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ হলাে। তেমুজিন আর খাসার মিলে খুন করে ফেলল সৎভাই বারগাতকে।
এরপর এল আরও কঠিন সময়। তৈয়ুচিদ গােত্রের দস্যুদের হাতে বন্দি হয়ে দাসে পরিণত হলাে তেমুজিন। অথচ এই তৈয়ুদিরা একদিন ছিল তার বাবার বন্ধু। তিন তিনটি বছর তাকে কাটাতে হয়েছে দাসত্বের মধ্যে। কিন্তু যার ভাগ্যে আছে মহাসম্রাট হওয়া, তাকে কি আর দাসত্ব মানায়? তৈয়ুচিদদের তাঁবু থেকে এক রাতে তেমুজিন পালিয়ে গেল। তাকে পালাতে সাহায্য করেছিল ওই তাবুর রক্ষীরই ছেলে চিলাউন। এত দিন যে তেমুজিন ছিল অসহায় শিকার, ষােল বছর বয়সে এসে সে শিকারীতে পরিণত হতে চাইল। তার সাথে যােগ দিল তার ভাই খাসার, দুই বাল্য বন্ধুরচু আর জেমি। একটু একটু করে এক শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তুলল ওরা ওদের বাহিনীতে ওপরে উঠার রাস্তা ছিল একটাই, মেধাবী আর বিশ্বস্ত হওয়া।
সানজাক ই উসমান পিডিএফ
এই ছয় বছর তেমুজিন বনে, জঙ্গলে, পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার হৃদয়ে ছিল বর্তি, তার প্রিয়তমা স্ত্রী। স্ত্রীকে নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষমতা তার আছে, মনে হবার সাথে সাথে তেমুজিন বর্তিকে নিজের কাছে নিয়ে এল। কিন্তু ভাগ্য এবারেও তাকে নির্মম এক কষাঘাত হানল।
যে মেরকিত গোত্র থেকে তার বাবা তার মাকে তুলে এনেছিলেন, প্রতিশোধ হিসেবে তারা এক রাতে অতর্কিত হামলা করে বসল তেমুজিনের গোত্রে। ঘোড়া কম থাকায় শুধু পুরুষরাই পালাতে পারল, ধরা পড়ে গেলেন হুয়েলোন, বর্তি ও অন্যান্য মেয়েরা।
তাদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করা হলো মাসের পর মাস।
প্রায় এক বছর পর শক্তিশালী এক মোঙ্গল খান তঘরুলের সহায়তায় বর্তিকে আবার ফিরিয়ে আনল তেমুজিন।
মেরকিতদের ওপর সে নির্মম প্রতিশোধ নিয়েছিল এর অনেক অনেক দিন পর।
আট মাস পর বর্তি এক ছেলের জন্ম দিল। ছেলের নাম রাখা হলো জোচি। জোচির আসল বাবা কে, তা নিয়ে শুরু হলো গুজব। তেমুজিন বুঝল, যদি জোচিকে সে অস্বীকার করেন, তাহলে প্রিয়তমা বর্তিকেও হারাতে হবে। জোচিকে নিজের সন্তান বলে গ্রহণ করল সে। তবে গোত্রের লোকেরা সব সময়েই জোচির পরিচয় নিয়ে সন্দেহ করেছে।
বর্তির এই অপহরণের ঘটনা তেমুজিনের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সে বুঝতে পারল, তাকে ক্ষমতাবান হতে হবে। মোঙ্গল স্তেপে টিকে থাকতে শক্তির কোনো বিকল্প নেই।
যেমনটা বলা আছে প্রাচীন তাতার প্রবাদে। “ইরিন মোর নিগেন বুই”। মানবজাতির পথ একটাই। যুদ্ধ !!
সানজাক ই উসমান pdf google drive
যুদ্ধই কাছাকাছি এনে দিয়েছিল দুই প্রিয় বন্ধু, রক্ত শপথের ভাই জমুখা আর তেমুজিনকে। জমুখা ছিলেন তেমুজিনের বিশ্বস্ততম কাছের বন্ধু।
জমুখা, তেমুজিন, জেলমি আর খাসার মিলে গড়ে তুলেছিলেন সবচেয়ে ছোট, কিন্তু দুর্ধর্ষ যোদ্ধার দল।
তেমুজিন যখন তার বাবার রক্ত শপথের ভাই তঘরুলের সহায়তায় মেরকিতদের কাছ থেকে বর্তিকে ছিনিয়ে আনলেন, তখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু সাফল্য অনেক সময়ই বন্ধুত্বে ফাটলের কারণ হয়।
মেরকিতদের সাথে লড়াইয়ের আগে মোঙ্গলদের প্রধান শামান কোচুকু ঘোষণা করেছিলেন, তেমুজিনের সাথে আছে স্বর্গের আশীর্বাদ। সে হবে এক মহান খান। এই লড়াইয়ে সেই জিতবে।
এই ঘোষণার কোথাও জমুখার কথা ছিল না। মোঙ্গল স্তেপে তেমুজিনের ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে জমুখার সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকল। এর প্রধান কারণ ছিল। ক্রমাগত ঈর্ষা আর সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে মতবিরোধ।
তেমুজিন চেয়েছিল বংশ মর্যাদা না, মেধার ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর কমান্ডার নিয়োগ দিতে। কিন্তু জমুখা নিজে ছিলেন এক গোত্র প্রধান, তাই তিনি এই পদ্ধতি মানলেন না। তিনি চাইতেন চিরায়ত মোঙ্গল প্রথা অনুযায়ী গোত্রীয় সম্মানের ওপরেই সেনাবাহিনীর নেতা নির্বাচিত হোক।
এই বিরোধের সময়েও তেমুজিন জমুখাকে অবিশ্বাস করতেন না। তিনি ভাবতেন, জমুখা আর যাই করুক তার সাথে কোনোদিন দ্বন্দ্বে নামবে না।
কিন্তু পুরুষের নিশ্চয়তাও যেখানে ভুল হয়, সেখানে প্রায়শই সঠিক প্রমাণিত হয় নারীর অনুমান। বর্তি আগেই সন্দেহ করেছিলেন জমুখাকে।