কুরআন কারীমের তাফসীরের নামে বহু জাল ও জয়ীফ হাদীস প্রচলিত আছে বহু তাফসীর-গ্রন্থ ও বই-পুস্তকে। আয়াতের ব্যাখ্যায় বা তার শানে-নুযুলের ব্যাপারে বহু এমন হাদীস ও আষার উল্লিখিত আছে, যার কোন সহীহ ভিত্তি নেই। বিধায় তা বিশ্বাস করা মুসলিমদের জন্য বৈধ নয়। সহীহ সুন্নাহর অনুসারী গণ সহীহ সুন্নাহর অনুসরণ করবে সর্বক্ষেত্রে। আকীদা, আহকাম, সীরাত, তারীখ ইত্যাদি সকল দ্বীনি বিষয়ে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহই হবে বিশুদ্ধতার মানদণ্ড।
শায়খ ওয়াদিয়ী সনদ উল্লেখ-সহকারে সহীহ-যয়ীফ বাতলে দিয়ে অনেক আয়াতের শানে-নুযূল এই পুস্তকে জমায়েত করেছেন। অনেকের ধারণা হতে পারে যে, প্রত্যেক আয়াত বা পুরো কুরআনের শানে নুযূল হয়তো এতে আছে, বাস্তব কিন্তু তা নয়। যতটুকু সহীহ ভাবে পাওয়া গেছে, কেবল ততটুকুই তিনি এতে উল্লেখ করেছেন।
বাংলার সাধারণ পাঠক হয়তো হাদীসের সনদ গুলো পড়তে বিরক্ত বোধ করবেন। কেউ ভাববেন, সহীহাইন বুখারী-মুসলিমের সনদ উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন ছিল। তবুও লেখক ‘মুসনাদ’ আকারে বইটি কে প্রকাশ করতে চেয়েছেন, কারো উপকারে লাগবে এই আশায়।
মহান আল্লাহ লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক ও পাঠক, সকলকেই জাযায়ে-খাইর প্রদান করুন। আমীন।
বিনীত—–
আব্দুল হামীদ আল ফাইযী আল-মাদানী
জামিয়া ইসলামিয়া (মদিনা ইউনিভার্সিটি) র জন্য যে গবেষণা-পুস্তিকা আমি পেশ করব, তার বিষয়বস্তু হল * শুদ্ধ সনদসহ” আসবাবুন নুযুল’। এ বিষয়টি এখতিয়ার করার কয়েকটি কারণ রয়েছেঃ-
১। বিষয়টি দুটি বিশাল গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যা আল্লাহর কিতাবের তাফসীর ও রাসূলুল্লাহ -এর সুন্নাহর সাথে সম্পৃক্ত, যা আমাদের দ্বীনের বুনিয়াদ।
২। আয়াতের শানে-নুযূল জানার ফলে তার অর্থ জানায় সহযোগিতা লাভ হয়। কিছু আয়াতের অর্থ কিছু সাহাবা ও তাঁদের পরবর্তিগণের বোঝার সমস্যা হলে শানে-নুযূল জেনে তারা তার সমাধান পেয়েছেন।
যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন,
“তোমরা নিজেরা নিজেদের সর্বনাশ করো না।” (বাকারা ১৯৫)
তাদেরকে তার শানে-
উক্ত আয়াত বুঝতে সাহাবাগণের সমস্যা হয়। অতঃপর আবু আইয়ুব আনসারী নুযুল বাতলে দিলে তাদের নিকট অর্থ স্পষ্ট হয়। যেমন যথাস্থানে তার বিবরণ আসবে ইনশাআল্লাহ। যেমন মহান আল্লাহর বাণী,
“যারা বিশ্বাস করেছে এবং তাদের বিশ্বাসকে যুলুম (শিক) দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত।” (আনআমঃ 82 )
শানে নুযুল pdf. আসবাবুন নুযুল pdf download
এই আয়াত বোঝার ব্যাপারে তাঁদের সমস্যা দেখা দিল। এক বর্ণনানুসারে সমাধানের জন্য আয়াত অবতীর্ণ হল,
“আল্লাহর অংশী করা তো বড় যুলুম।’ (লুকমানঃ ১৩)
যেমন এ কথা যথাস্থানে উল্লিখিত হবে।
মহান আল্লাহর বাণী,
“নিশ্চয় স্বাফা ও মারওয়া (পাহাড় দু’টি) আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। সুতরাং যে কা’বাগৃহের হজ্ব কিংবা উমরাহ সম্পন্ন করে তার জন্য এই (পাহাড়) দুটি প্রদক্ষিণ (সাঈ) করলে কোন পাপ নেই। আর কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন পুণ্য কাজ করলে, আল্লাহ গুণগ্রাহী, সর্বজ্ঞাতা।” (বাক্বারাহ : ১৫৮)
উক্ত আয়াতের ব্যাপারে উরওয়ার মনে সমস্যা দেখা দিল। পরিশেষে আয়েশা (রাম্বিয়াল্লাহু আনহা) তাঁকে তার শানে-নুযূল জানিয়ে সমাধান দিলেন।
৩। যে সকল কারণে আমি এই বিষয় নির্বাচনে অনুপ্রাণিত হয়েছি, তার অন্যতম হল, কুরআনী শানে-নুযূল বিদ্যায় বহু ভেজাল অনুপ্রবেশ করেছে, যেমন অনুরূপ সকল বিদ্যায় ভেজাল অনুপ্রবেশ করেছে। ওয়াহেদী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর গ্রন্থ ‘আসবাবুন নুযূল )-এর ভূমিকায় লিখেছেন, আবীদাহ সালমানীকে কুরআনের একটি আয়াত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, “তুমি আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। তাঁরা গত হয়েছেন, যারা জানতেন কুরআন কোন ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।’
শানে নুযুল pdf. আসবাবুন নুযুল pdf download
অতঃপর ওয়াহেদী লিখেছেন, “আর আজকে প্রত্যেকেই নিজের লাগামকে অজ্ঞতার হাতে সঁপে দিয়ে এবং আয়াতের শানে-নুযূল না জেনে কথা বলার শাস্তির ধমকের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা না ক’রে নতুন কিছু উদ্ভাবন করছে, অবাস্তব ও মিথ্যা রচনা করছে। এই বাস্তবতাই আমাকে শানে-নুযুলের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ এই গ্রন্থ রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। যাতে উক্ত বিষয়ে অনুসন্ধানী ছাত্র এবং কুরআনী আয়াতের শানে-নুযূল নিয়ে যারা কথা বলে, তারা এর প্রতি রুজু করতে পারে। সঠিকটা জানতে পারে, বিভ্রান্তি ও মিথ্যার আশ্রয় থেকে অমুখাপেক্ষী হতে পারে এবং শ্রবণ ও অনুসন্ধানের পর তার সুরক্ষা করতে সচেষ্ট হতে পারে।
সুয়ূতী তাঁর ‘আল-ইতকান’ গ্রন্থে(ণ) এক দল মুফাসসির যেমন ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম প্রমুখ যারা সনদ-সহ তফসীর পেশ ক’রে থাকেন, তাঁদের কথা উল্লেখ ক’রে বলেছেন, ‘অতঃপর বহু লেখকই তফসীর বিদ্যায় গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা সনদ বাদ দিয়ে সংক্ষেপ করেছেন এবং পর্যায়ক্রমে উক্তিসমূহ উদ্ধৃত করেছেন। তার ফলে এই পথে ভেজাল অনুপ্রবেশ করেছে এবং শুদ্ধের সাথে অশুদ্ধ একাকার হয়ে গেছে। অতঃপর প্রত্যেকেই যার উক্তি সামনে পেয়েছে, তা উল্লেখ করেছে এবং মনে যা উদয় হয়েছে, তা ভিত্তি করে বসেছে। অতঃপর তার পরে যে আসে, সে তার নিকট থেকে তা নকল করে—এই ধারণা ক’রে যে, তার কোন বুনিয়াদ আছে। তখন সে সলফে সালেহীন ও তফসীরের ব্যাপারে যাদের প্রতি রুজু করা হয়, তাঁদের প্রতি ভ্রক্ষেপ করে না। এমনকি আমি একজনকে দেখেছি, তিনি
“তাদের পথ –যারা ক্রোধভাজন নয় এবং যারা পথভ্রষ্টও নয়।”
শানে নুযুল pdf. আসবাবুন নুযুল pdf download
মহান আল্লাহর এই বাণীর ব্যাপারে প্রায় ১০টি উক্তি উল্লেখ করেছেন।
অথচ এর তফসীরে ‘ইয়াহুদী-খ্রিস্টান’ উদ্দিষ্ট। এ কথাই নবী এবং তাঁর সকল অনুসারীবর্গ থেকে বর্ণিত আছে। এমনকি ইবনে আবী হাতেম বলেছেন, ‘এ বিষয়ে মুফাসসিরীনদের মাঝে কোন মতভেদ আমি জানি না।’
আমি (লেখক) বলি, এই বাস্তবতাই আমাকে যথাসাধ্য সনদ উল্লেখ করতে উৎসাহিত করেছে। যদিও তাতে পরিশ্রম ও কষ্ট আছে, যেমন এ বিদ্যার পন্ডিতগণের কাছে তা বিদিত।
পাঠকের নিকট একটি উদাহরণ পেশ করছি, যা উক্ত ইমামদ্বয় যা বলেছেন, তার সত্যায়ন করবে। আর তা এই যে, তফসীর-গ্রন্থসমূহে অপ্রমাণিত উক্তি উদ্ধৃত করার ব্যাপারে শৈথিল্য আপতিত হয়েছে। উদাহরণটি হল যা’লাবাহ বিন হাত্বেকের কাহিনী। যাতে আছে, (তিনি ধন চাইলে নবী তাঁকে বললেন,) “সেই অল্প যার তুমি শুকরিয়া আদায় কর, সেই অধিক থেকে উত্তম, যা তুমি বহন করার ক্ষমতা রাখো না।” উক্ত ঘটনাটি মুফাসসিরগণ উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহর এই আয়াত তফসীরের সময়,
“তাদের মধ্যে এমন কতিপয় লোক রয়েছে, যারা আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল, আল্লাহ যদি আমাদেরকে নিজ অনুগ্রহ হতে দান করেন, তাহলে অবশ্যই আমরা দান-খয়রাত করব এবং সংলোকদের অন্তর্ভুক্ত হব।” (তাওবাহঃ ৭৫)
শানে নুযুল pdf. আসবাবুন নুযুল pdf download
এমন কোন তফসীর-গ্রন্থ নেই, যাতে উক্ত ঘটনা উল্লিখিত নেই। পরন্তু খুব কম সংখ্যকই মুফাসসির সতর্ক করেছেন যে, তা সহীহ নয়।
পক্ষান্তরে প্রখ্যাত হাদীসবিশারদ ও সমালোচকগণ উক্ত ঘটনার ব্যাপারে কী বলছেন, পড়ুন :-
ইমাম আবু মুহাম্মাদ বিন হাযম (রাহিমাহুল্লাহ) ঘটনাটি মিসকীন বিন বুকাইর সূত্রে উল্লেখ করেছেন। মিসকীন বলেন, আমাদেরকে মাআন বিন রিফাআহ সুলামী খবর দিয়েছেন, তিনি আলী বিন য্যাযীদ হতে, তিনি কাসেম বিন আব্দুর রহমান হতে, তিনি আবু উমামাহ হতে, তিনি বলেছেন, যা’লাবাহ বিন হাবে তাঁর সদকা নিয়ে উমারের কাছে এলে তিনি তা গ্রহণ করলেন না এবং বললেন, ‘নবী তা গ্রহণ করেননি, আবু বাকরও না, আমিও তা গ্রহণ করব না।’
আবু মুহাম্মাদ বলেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বাতিল। যেহেতু মহান আল্লাহ মুসলিমদের যাকাত গ্রহণ করতে আদেশ দিয়েছেন এবং নবী ইন্তিকালের সময় আদেশ দিয়েছেন যে, “আরব বদ্বীপে যেন দুটি দ্বীন অবশিষ্ট না থাকে।” আর যা’লাবাহ হয় মুসলিম হবে, তাহলে আবু বাকর ও উমারের জন্য অবশ্য-অবশ্যই তার যাকাত গ্রহণ করা ফরয, তাতে কোন প্রশস্ততা নেই। পক্ষান্তরে সে যদি কাফের হয়, তাহলে তাঁদের জন্য ফরয ছিল আরব বদ্বীপে তাকে অবশিষ্ট না রাখা। সুতরাং এ আষার নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য নয়। আর এর বর্ণনাসূত্রে রয়েছে মাআন বিন রিফাআহ, কাসেম বিন আব্দুর রহমান, আলী বিন য়্যাযীদ আবু আব্দুল মালেক আলহানী, এরা সবাই দুর্বল রাবী। আর মিসকীন বিন বুকাইর শক্তিশালী রাবী নয়। (মুহান্না ১১ /২০৮)