অগাস্টের ৬ তারিখ। দিনটা শুরু হয়েছিল গ্রীষ্মের অন্য দশটা স্বচ্ছ, উজ্জ্বল দিনের মতোই। সকাল সাতটার দিকে বেজে ওঠা পাগলা ঘন্টির শব্দ ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া শহরবাসীর কাছে খুব একটা গুরুত্ব পেল না। আরও কম গুরুত্ব পেল এক ঘণ্টা পর বেজে ওঠা বিপদ কেটে যাওয়ার সংকেত। কর্মব্যস্ত দিনের প্রস্তুতি নিতে থাকা শহরটার বাসিন্দাদের কাছে হয়তো অনিশ্চিত বিপদের আশঙ্কায় সময় কাটানো বিলাসিতা মনে হয়েছিল।
ঠিক পনেরো মিনিট পর, সকাল ৮.১৫ তে আকাশের বুকে দেখা দিলো এক নিঃশব্দ আলোর ঝলকানি। সাদার চেয়েও সাদা। তার ঠিক পরপর, এক বিকট, ভোঁতা শব্দ। সহস্র সূর্যের উজ্জ্বলতা নিয়ে আকাশের বুক চিরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছুটে গেল আগুনের সোনালি সন্ত্রাস। মুহূর্তের মধ্যে লন্ডভন্ড হয়ে গেল প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের শহরটা। স্রেফ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল বিস্ফোরণস্থলের এক মাইলের মধ্যে প্রায় সবকিছু। ইট, কাঠ ও কংক্রিটের পাশাপাশি বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আঘাত শহরের অধিবাসীদেরও প্রবল শক্তিতে ছুঁড়ে দিলো এদিক-সেদিক। তারপর শহরটাকে গ্রাস করল আগুনের উড়ন্ত ঝড়।
চিন্তাপরাধ pdf
বৃদ্ধ বাবার চশমা, নিশ্চিন্ত চোখে পৃথিবীকে দেখতে থাকা আধো আধো বোলের শিশু, সতর্কতার সাথে বাছাই করা খেলার সাজ সরঞ্জাম আর দোলনা, দুই ঝুটি করা স্কুল ড্রেসের ছোট্ট খুকির হাসি, ক্লাসের দুষ্ট ছেলেটার লাল ব্যাগ, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ স্ত্রীর কথা মনে পড়ায় অন্যমনস্ক যুবক, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে পথের কোলাহলের দিকে চেয়ে থাকা ভেজা চুলের তরুণী, অর্ধেক অঙ্ক কষা ব্ল্যাকবোর্ড, সদ্য খোলা অফিসের পেটমোটা ফাইল, ঘাসফুল, প্রজাপতি,পাখি … নিমিষেই মুছে গেল সবাই, সবকিছু। আগুনের তীব্র উত্তাপে ঝলসে গেল টিকে থাকা অল্প কিছু রাস্তা, দেয়াল আর ব্রিজের রং। খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের অনেকের ছায়া স্থায়ীভাবে গেঁথে গেল সেখানে। বিস্ফোরণের এক মিনিটের মধ্যে মারা গেল এক লক্ষের মতো মানুষ, আহত হলো আরও প্রায় এক লক্ষ। ধীরে ধীরে শহরটার ওপর আকাশটাকে ঢেকে দিতে শুরু করল ব্যাঙের ছাতার মতো পাক খেতে থাকা ধোঁয়া আর ধুলোর বিশাল এক মেঘ।
রাস্তা আর ফুটপাতজুড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমাণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা হাজারো মানুষ দিনভর তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো ঠায় বসে রইল, বমি করল, তারপর মারা গেল। পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে কোনো মতে নদীর পাড় পর্যন্ত এসে সব শক্তি হারিয়ে সেখানেই নিথর শুয়ে থাকল আরও কয়েক হাজার। সন্ধ্যার দিকে বাড়তে থাকা নদীর পানিতে নীরবে, নিঃশব্দে তলিয়ে গেল অনেকে। আর নৌকায় উঠানোর জন্য হাত ধরে টানতেই নিচের মাংস উন্মুক্ত করে সড়সড় করে গ্লাভস এর মতো খুলে এল কারও কারও রক্ত- পুঁজ মাখানো চামড়া।
চিন্তাপরাধ আসিফ আদনান pdf download
চুরমার হয়ে যাওয়া হিরোশিমার রক্ত-মাংসে পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে এলোমেলো হাঁটতে দেখা গেল জনা বিশেক সৈনিককে। শূন্য চোখের কোটরের নিচে পুড়ে যাওয়া গাল বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে ওদের গলিত চোখ। সম্ভবত বিস্ফোরণের সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল ওরা।
চরম বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে ১৯৪৫ এর ৬ই অগাস্ট হিরোশিমার মাটি থেকে ১,৯০০ ফুট ওপরে ৬৪ কেজি ইউরেনিয়াম-২৩৫ নিয়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল ‘লিটল বয়’, মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুদ্ধাবস্থায় ব্যবহৃত আণবিক বোমা। লিটল বয়ের আঘাতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল হিরোশিমার ৭০% বিল্ডিং। অ্যামেরিকান দাবি অনুযায়ী প্রথম দিনে মৃতের সংখ্যা ৬০-৯০ হাজারের কাছাকাছি। জাপানিদের মতে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। তিন মাস পর ১৯৪৫ এর ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী এ বোমার কারণে নিহতের মোট সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার। হিরোশিমা নগর কর্তৃপক্ষ, জাপানের স্বাস্থ্য এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাতে ছাপা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের ২০১৬ এর রিপোর্ট অনুযায়ী বিস্ফোরণ-পরবর্তী দশকগুলোতে রেডিয়েশন জনিত অসুস্থতায় মৃতদের হিসেবে ধরলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৩ লাখের কাছাকাছি। তিন দিন পর নাগাসাকিতে ফেলা হয় দ্বিতীয় আণবিক বোমা, ফ্যাট ম্যান।
ছয় দিন পর, ১৯৪৫ সালের ১৫ই আগস্ট, জাপান আত্মসমর্পণ করে।
চিন্তাপরাধ বই
অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, অভূতপূর্ব এ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল এমন সময়ে যখন জাপান সম্মানজনক আত্মসমর্পণের পথ খুঁজছিল। ৬ আগস্টের আগেই অ্যামেরিকান সামরিক গোয়েন্দারা জাপানের পাঠানো কোডেড মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল এবং নিশ্চিতভাবে জানতে পেরেছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে জাপান আত্মসমর্পণের চেষ্টা করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার ডোয়াইট আইসেনহাওয়ার, জাপানের বিরুদ্ধে চালানো সব বিমান হামলার দায়িত্ব থাকা মেজর জেনারেল কার্টিস লি-মেই, প্যাসিফিক কমান্ডার ইন চীফ চেস্টার নিমিট্য, প্রেসিডেন্টের চিফ অফ স্টাফ উইলিয়াম লিহি, জাপানের পাঠানো গোপন বার্তা ইন্টারসেপ্ট করার পর আমেরিকান সরকারের কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানোর দায়িত্বে থাকা মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কার্টার ক্লার্ক সহ অনেকেই স্বীকার করেছে যে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর আণবিক বোমা হামলা ছিল অপ্রয়োজনীয়।
তবুও সামরিকভাবে অপ্রয়োজনীয় এ হামলার সিদ্ধান্ত নেয় অ্যামেরিকা। বিশ্বমঞ্চে ‘অপ্রতিরোধ্য, অজেয়, মহাশক্তিধর সুপারপাওয়ার’ হিসেবে নিজের কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত করা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তৃত্ব প্রতিহত করা—আণবিক বোমা হামলার মাধ্যমে এক ঢিলে এ দুই পাখি মারার ফন্দি আঁটে অ্যামেরিকা। অ্যামেরিকার ভূ-রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ আর কূটনীতির বলি হতে হয় হিরোশিমা ও নাগাসাকির প্রায় চার লক্ষ মানুষকে।
ক্ষমতার নেশায় বেসামাল, ব্যাপক ও বিস্তৃত আধুনিক হত্যাযজ্ঞের উদগ্রীব স্থপতি অ্যামেরিকার এ হামলা শুধু গণহত্যা ছিল না, ছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস-সত্যিকার অর্থে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। হিরোশিমার বিস্ফোরণের ১৬ ঘণ্টা পর অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান নিচের বক্তব্য দেয়:
‘১৬ ঘণ্টা আগে জাপানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি হিরোশিমাতে একটি বোমা ফেলেছে মার্কিন বিমান। এ বোমাটি ছিল ২০,০০০ টন টি.এন.টির চেয়ে বেশি শক্তিশালী, এর আগে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বোমা হিসেবে স্বীকৃত ‘ব্রিটিশ গ্র্যান্ড স্ল্যাম’ এর চেয়ে প্রায় ২,০০০ গুণ বেশি বিস্ফোরণ ক্ষমতাসম্পন্ন। পটুম্যানের সাড়ে এগারো শ শব্দের পুরো বক্তব্য জুড়ে বারবার ফুটে ওঠা তিনটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করার মতো।
চিন্তাপরাধ বই pdf
প্রথমত, বিপুল বিধ্বংসী ভীতিকর ধ্বংস ক্ষমতা সম্পন্ন মারণাস্ত্র তৈরি ও ব্যবহার করতে পারার গর্ব।
দ্বিতীয়ত, অবিশ্বাস্য মাত্রার হত্যাযজ্ঞ আর মানবিক বিপর্যয়ের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অনুশোচনার অনুপস্থিতি।
তৃতীয়ত, ‘গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি’ নাম দিয়ে সাড়ে তিন লক্ষ মানুষের জ্বলজ্যান্ত একটা শহরকে সামরিক টার্গেট হিসেবে চিত্রিত করা আর বেসামরিক জনগণের পাইকারি খুনের বৈধতা তৈরি।
১৯৪৬ থেকে গত ৭৩ বছরে আমেরিকা পেশাদারি দক্ষতা আর নির্লিপ্ত নৈপুণ্যের সাথে পৃথিবীজুড়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যা করেছে প্রায় ২ কোটি মানুষ। নিয়মিত বিরতিতে চালানো গণহত্যার পর ট্রুম্যানের মতই একই রকম নির্বিকার আত্মবিশ্বাস আর গর্ব মেশানো আনুষ্ঠানিকতার সাথে ঠিক একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে গেছে অ্যামেরিকার অন্যান্য প্রেসিডেন্টরাও। ট্রুম্যানের পর আরও ১২ জন প্রেসিডেন্ট এলেও বদলায়নি সন্ত্রাসী হামলার পর অ্যামেরিকার দায় স্বীকারের এ মুখস্থ স্ক্রিপ্ট। ধ্বংসের প্রযুক্তির প্রতি প্রায় যৌনায়িত মুগ্ধতা, নির্বিকার অনুশোচনা হীনতা এবং নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির সন্ত্রাসকে শান্তি, মানবতা, গণতন্ত্র কিংবা অন্য কোনো আদর্শের নামে চালিয়ে দেয়া—যুগ যুগ ধরে অ্যামেরিকান গণহত্যাকে বিশেষায়িত করে আসছে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য।