বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, আজকে আলোচনা করার বিষয় হচ্ছে কুরবানী শব্দের অর্থ কি, কুরবানীর মাসায়েল, কোরবানির নিয়ম কানুন, কুরবানীর ইতিহাস, কুরবানির উদ্দেশ্য, কোরবানির বিধান, কুরবানী কবুল হওয়ার শর্ত, কোরবানির পশু কেমন হতে হবে, কোরবানির সময়, কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম, কোরবানির পশু জবাই করার দোয়া আরবী, কোরবানির গোশত বন্টনের নিয়ম ইত্যাদি।
Table of Contents
Toggleকুরবানী শব্দের অর্থ কি
আরবী কুরবান শব্দটি ফারসী বা উর্দুতে কুরবানী রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ নৈকট্য। আর কুরবান শব্দটি কুরবাতুন শব্দ থেকে উৎপন্ন। আরবী কুরবাতুন এবং কুরবান উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ নিকটবর্তী হওয়া, কারো নৈকট্য লাভ করা প্রভৃতি। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে যে পশু যবেহ করা হয় তার নামই কুরবান বা কুরবানী।
আল কোরআনে কুরবান শব্দটি তিন জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। আর হাদিসে কুরবান শব্দের পরিবর্তে উযহিয়্যাহ এবং যাহিয়্যাহ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। উযহিয়্যাহ কুরবানীর দিনসমূহে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে যবেহযোগ্য উট, গরু, ছাগল বা ভেড়াকে বলা হয়। এ শব্দটি যুহা শব্দ থেকে গৃহীত যার অর্থ পূর্বাহ্ন। যেহেতু কুরবানী যবেহ করার উত্তম সময় হল ১০ যিলহজ্জের অর্থাৎ ঈদের দিনের পূর্বাহ্নকাল তাই ঐ সামঞ্জস্যের জন্য তাকে উযহিয়্যাহ বলা হয়েছে। এটিকে আবার যাহিয়্যাহ বা আযহাহও বলা হয়। আর আযহাহ এর বহুবচন আযহা যার সাথে সম্পর্ক জুড়ে ঈদের নাম হয়েছে ঈদুল আযহা।
কোরবানির ফজিলত
১. কুরবানী দাতা কুরবানীর পশু জবাই এর মাধ্যমে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতের বাস্তবায়ন করতে পারে। আল কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
আর আমরা মহা কুরবানীর বিনিময়ে তাকে মুক্ত করেছি।
[সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ১০৭]
এ আয়াতের তাফসীরে তাফসীর বিশারদগণ উল্লেখ করেছেন, সকল কুরবানী এ মহা কুরবানীর অন্তর্ভুক্ত। এ জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ ইবনে আরকাম বর্ণিত হাদীসেও কুরবানীকে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এর সুন্নত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
২. কুরবানীর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জিত হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে।
[সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত : ৩৭]
৩. কুরবানী আল্লাহ তাআলার অন্যতম নিদর্শন। সূরা আল-হাজ এর ৩৬ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
কুরবানীর উটসমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনের অন্যতম করেছি। তোমাদের জন্য যাতে কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় এগুলোর উপর তোমরা আল্লাহর নাম স্মরণ করো আর যখন কাত হয়ে পড়ে যায় তখন সেগুলো হতে খাও। আর আহার করাও ধৈর্য্যশীল অভাবী ও ভিক্ষাকারী অভাবগ্রস্তকে। এভাবে আমরা তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
[সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৩৬]
এ আয়াতে কুরবানীর ফযীলত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং কুরবানীর পশুকে আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
৪. পশু দ্বারা কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর যিকির বা স্মরণের বাস্তবায়ন করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে:
আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে।
[সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৩৪]
৫. পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অভাবীদের আনন্দ দান। আর এটা অন্য এক ধরনের আনন্দ যা কুরবানীর গোশতের পরিমাণ টাকা যদি আপনি তাদের সদকা দিতেন তাতে অর্জিত হতো না। কোরবানি না করে তার পরিমাণ টাকা সদকা করে দিলে কুরবানী আদায় হবে না।
কুরবানীর ফজিলত সম্পর্কে বর্ণিত কোন হাদীসই বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়; বরং এ সম্পর্কে বর্ণিত সবগুলো হাদীসই যঈফ ও জাল। তারপরও কুরবানীর সময় নিকটবর্তী হলে ব্যাপক আকারে এ হাদীসগুলোর ছড়াছড়ি দেখা যায়। বক্তা, লেখক, প্রবন্ধকার সমানভাবে ঐ যঈফ ও জাল হাদিস গুলো চর্চা করেন। কেউ সেগুলো জুমার খুতবায় মধুর সুরে পাঠ করেন, কেউ তা নিজ প্রবন্ধে পরিবেশন করে প্রবন্ধের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। আবার কেউ বক্তৃতার মঞ্চে পাঠ করে মঞ্চ গরম করেন। আর কুরবানীর ঈদের খুতবার সময় তো শতকরা ৯৫ ভাগ খত্বীবই ঐ হাদীসগুলোকে খুতবার মূল পুঁজি হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। এর একমাত্র কারণ হলো চরম উদাসীনতা ও অজ্ঞতা। ইমাম মুসলিম (রহ.)- এর ভাষায়, ‘যারা যঈফ ও জাল হাদীস জেনে শুনে (সতর্কীকরণ ছাড়াই) বলে বেড়ান তারা আলেম উপাধি পাবার চেয়ে জাহেল উপাধি পাবার অধিক হকদার এবং তারা সাধারণ মুসলিম সমাজকে ধোঁকা দানকারী বলে গণ্য হবে। (সহীহ মুসলিম শরীফের ভূমিকা প্র.)।
কুরবানীর ইতিহাস
পৃথিবীর সর্বপ্রথম কুরবানী
কুরবানীর ইতিহাস খুবই প্রাচীন। সেই আদি পিতা আদম (আ) এর যুগ থেকেই কুরবানীর বিধান চলে আসছে। আদম (আ) এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীলের কুরবানী পেশ করার কথা আমরা মহাগ্রন্থ আল কোরআন থেকে জানতে পারি।
মহান আল্লাহ বলেন,
আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও যখন তারা উভয়ে কুরবানী নিবেদন করেছিল তখন একজনের কুরবানী কবুল হল এবং অন্যজনের কুরবানী কবুল হল না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বলল আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন। (সূরা মায়িদা:-২৭)
ইব্রাহীম (আ) এর কুরবানী
ইব্রাহীম (আ.)এর কুরবানী থেকেই মূলত আমাদের উপর কুরবানী ওয়াজীব করা হয়েছে; (ইব্রাহিম আমার কাছে দোয়া করল) হে আমার পালনকর্তা তুমি আমাকে এক সৎকর্মশীল পুত্র সন্তান দান কর; অতঃপর আমি তাকে এক অতি ধৈরযশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম; অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে চলাফিরা করার বয়সে পৌঁছল; তখন ইব্রাহীম বলল বৎস আমি স্বপ্নে দেখেছি যে; আমি তোমাকে যবেহ করছি; এখন বল তোমার অভিমত কি? সে বলল; হে পিতা আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন; আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলই পাবেন।
দুজনেই যখন আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিলো; আর ইব্রাহীম তাকে কাত করে শুইয়ে দিলো; তখন আমি তাকে ডাক দিলাম; হে ইব্রাহীম !স্বপ্নে দেয়া আদেশ তুমি সত্যে পরিণত করেই ছাড়লে। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি; অবশ্যই এটা ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা; আমি এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে পুত্রটিকে ছাড়িয়ে নিলাম; আর আমি তাকে পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয় করে রাখলাম; ইব্রাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক! সৎকর্মশীলদেরকে আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি; সে ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা আস সাফফাত:১০০-১১১)
কুরবানির উদ্দেশ্য
পশু নিবেদন বা যবেহ করার উদ্দেশ্য হল এক আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা, তাকে সন্তুষ্ট করা অর্থাৎ তার ইবাদাত করা। আর আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদাত করার জন্য। যেমন তিনি বলেছেন,
আমি জিন ও মানুষকে এজন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা শুধু আমার ইবাদাত করবে। (সূরা আয -যারিয়াত : ৫৬)
ইবাদাত হল তাওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর একত্ববাদকে মান্য করে চলার নাম; তাই পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষী দেই; যেমনটি ইব্রাহীম (আ) করেছিলেন এবং হাবিল করেছিলেন।
কোরবানির বিধান
কুরবানী বিধেয় হওয়ার ব্যাপারে সকল মুসলিম একমত। এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। তবে কুরবানীর হুকুম কি; ফরজ না ওয়াজিব নাকি সুন্নাত? এ বিষয়ে ইমাম ও ফকীহদের মাঝে দুটো মত রয়েছে।
প্রথম মত – কুরবানী ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানিফা (র) প্রমুখের মত এটাই। আর ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদ রহ থেকে একটি মত বর্ণিত আছে যে, তারাও ওয়াজিব বলেছেন।
দ্বিতীয় মত – কুরবানী সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ; এটা অধিকাংশ উলামাদের মত; ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেয়ী (র) এর প্রসিদ্ধ মত এটি; কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন সামর্থ্য থাকা অবস্থায় কুরবানী পরিত্যাগ করা মাকরুহ; যদি কোন জনপদের লোকেরা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সম্মিলিতভাবে কুরবানী পরিত্যাগ করে; তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে; কেননা কুরবানী হল ইসলামের একটি মহান নিদর্শন।
যারা কুরবানী ওয়াজিব বলেন তাদের দলিল-
১. আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন –
তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু যবেহ কর। (সুরা কাওসার:২)
আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ পালন ওয়াজিব হয়ে থাকে।
২. রাসুল (স) বলেছেন –
যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে।(মুসনাদ আহমাদ, হাকেম, ইবনে মাজাহ)
যারা কুরবানী পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদিস একটি সতর্কবাণী। তাই কুরবানী ওয়াজীব।
৩. রাসুল (স) বলেছেন-
হে মানব সকল! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হল প্রতি বছর কুরবানী দেয়া।(মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ)
যারা কুরবানী সুন্নত বলেন তাদের দলিল-
১. রাসুল (স) বলেছেন- তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করতে চায়; যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কুরবানী সম্পন্ন করার আগে তার কোন চুল ও নখ না কাটে।
সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৭৭।
এ হাদিসে রাসুল (স) এর ‘যে কুরবানী করতে চায়’ কথা দ্বারা বুঝা যায় এটা ওয়াজীব নয়।
২. রাসুল (স) তার উম্মতের মাঝে যারা কুরবানী করেনি তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন; তার এ কাজ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে; কুরবানী ওয়াজিব নয়।
ফায়সালা
আমার মতে কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার মতটিই সঠিক; কারন আল্লাহ তায়ালা রাসুল (স) কে নির্দেশ দিয়েছেন কুরবানী পেশ করতে; এবং রাসুল (স) আমাদেরকে কুরবানীর তাকিদ দিয়েছেন ও সতর্কবাণী পেশ করেছেন।
অপরদিকে, কুরবানী সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে যে দুইটি দলিল পেশ করা হয়েছে; তার প্রথমটিতে বলা হয়েছে; রাসুল (স) বলেছেন- তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করতে চায়; যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কুরবানী সম্পন্ন করার আগে তার কোন চুল ও নখ না কাটে; আসলে এই হাদিসে কুরবানীর বিধান বর্ণনা করা মূল উদ্দেশ্য নয়; বরং মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যিলহজ্জ মাসের শুরু থেকে কুরবানী সম্পন্ন করা পর্যন্ত নির্দিষ্ট একটি আমলের কথা বর্ণনা করা; কুরবানী করা বা না করা, কুরবানী কে করবে বা কে না করবে এটা আলোচ্য বিষয় নয়; আলোচ্য বিষয় ঐ নির্দিষ্ট আমল; আর সবার কুরবানী পেশ করার সামর্থ্য থাকে না, আবার সামর্থ্য থাকলেই সবাই করে না, যে কুরবানী পেশ করার ইচ্ছা করেছে সে যেন ঐ নির্দিষ্ট আমলটি করে, হাদিসের মূল আলোচনা এটাই; অতএব এই হাদিস দ্বারা কুরবানীর বিধানের দলিল দেয়া যায় না।
আর দ্বিতীয় দলিলে বলা হয়েছে,
রাসুল (স) তার উম্মতের মাঝে যারা কুরবানী করেনি তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন। এখানে যারা সামর্থ্য না থাকার কারনে দেয়নি আর রাসুল (স) তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়েছেন যদি এমনটা হয়ে থাকে তবে এটা কুরবানীর বিধানের দলিল হয় না কারন যাদের সামর্থ্য নেই তাদের উপর বিধান নেই।
আর যদি এমনটাই হবে যে; রাসুল (স) তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করেনি; তাহলে তিনি তাদেরকে ঈদগাহে আসতে নিষেধ করলেন কেন; যেমনটি ঈদগাহে আসতে নিষেধ করেছেন তাদেরকে যারা রামাযানের একমাস সিয়াম পালন না করবে। অতএব যাদের সামর্থ্য আছে; কুরবানী পেশ করা তাদের উপর ওয়াজিব; এই মতটিই সঠিক। তাই যারা কুরবানীর বিধান শিথিল মনে করেন বা ঐচ্ছিক মনে করেন; তারা এই ধারণা ছুড়ে ফেলে দিয়ে কুরবানী পেশ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান; ঈদুল আযহার দিনে সর্বউত্তম ইবাদাত হল কুরবানী পেশ করা; অর্থাৎ পশুর রক্ত প্রবাহিত করা।
কুরবানী কার উপর ওয়াজিব
যে ব্যক্তি তার নিজের এবং তার অধিনস্তদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার পর কুরবানী পেশ করার সামর্থ্য রাখে তার উপর কুরবানী দেয়া ওয়াজিব। ব্যক্তির যদি ঋণ থাকে তবে সেই ঋণ পরিশোধের মতো অর্থ থাকার পর যদি কুরবানী দেয়ার সামর্থ্য থাকে তবেই তার উপর কুরবানী দেয়া ওয়াজিব। কুরবানীর সঙ্গে যাকাতের নেসাবের কোন সম্পর্ক নেই।
আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের কাছেও না আসে।
ইবনে মাজাহ ৩১২৩, আহমাদ ৮০৭৪, তাখরিজুল মুশকিলাতুল ফিকর ১০২, আত-তালীকুর রাগীব ২/১০৩। তাহকীক আলবানী হাসান।
মিখলাফ ইবনে সুলাইম (রাঃ) থেকে বর্ণিত: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর একটি কোরবানী দেয়া ওয়াজিব।
মুসনাদে আহমদ ২০২০৭, আবু দাউদ ২৭৮৮, ইবনে হাজার ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বলেন: হাদিসটির সনদ মজবুত। আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।
এ বিধানের ক্ষেত্রে পুরুষ বা নারীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অতএব, কোন নারী যদি একাকী বসবাস করেন কিংবা তাঁর সন্তানদেরকে নিয়ে থাকেন এবং তার কুরবানী করার সামর্থ থাকে তবে তাকে কোরবানী পেশ করতে হবে।
কোরবানী ওয়াজিব হওয়া কিংবা সুন্নত হওয়ার জন্য পুরুষ হওয়া শর্ত নয়। কোরবানী পুরুষদের উপর যেমন ওয়াজিব হয় তেমনি নারীদের উপরও ওয়াজিব হয়। কারণ ওয়াজিব হওয়ার দলিলগুলো নর-নারী সবাইকে সমানভাবে শামিল করে।
আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা ৫/৭৯-৮১
কুরবানী কবুল হওয়ার শর্ত
কুরবানী পেশ করা একটি ইবাদাত; আর ইবাদাত তখনই আল্লাহর নিকটে গ্রহণযোগ্য হবে; যখন সেটা আসলেই ইবাদাত হবে; ইবাদাত যদি হয় ইবাদাতের মতো তবেই তা গ্রহণযোগ্য হবে; আর যদি তা হয় অন্য কিছুর মতো তবে তা কি করে কবুল হবে; অতএব ইবাদাত কি সেটা খুব ভালভাবে বুঝতে হবে; তবেই আপনি ইবাদাত করতে পারবেন এবং তা কবুল হবে ইনশাআল্লাহ।
কোরবানির পশু কেমন হতে হবে
১.ছয় প্রকার পশু কুরবানী করা যায় আর তা হল উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। এর মধ্যে সর্বউত্তম হল শিংওয়ালা সাদাকালো দুম্বা।
২.কুরবানীর পশু নির্দিষ্ট বয়সের হতে হবে। উট পাঁচ বছর,গরু বা মহিষ দুই বছর, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এক বছর বয়সের হতে হবে। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কুরবানী করা যেতে পারে।
৩.কুরবানীর পশু যাবতীয় দোষত্রুটি মুক্ত হতে হবে। যেমন হাদিসে এসেছে-
সাহাবী বারা ইবনে আযেব (রা) বলেন, রাসুল (স) আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন তারপর বললেন, চার ধরনের পশু দিয়ে কুরবানী জায়েয হবে না। অন্ধ. যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত. যার রোগ স্পষ্ট,পঙ্গু. যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত. যার কোন অঙ্গ ভেঙে গেছে। –তিরমিযী।
কোরবানির নিয়ম
১. কুরবানীর জন্য পশু পূর্বেই নির্ধারণ করতে হবে।
২. নির্ধারিত পশু অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা যাবে না, দান করা যাবে না, বিক্রি করা যাবে না। যেহেতু যা আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে তার ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়। তবে কুরবানী ভালভাবে আদায় করার জন্য তার চেয়ে উত্তম পশু দ্বারা পরিবর্তন করা যাবে।
৩. যদি পশুর মালিক ইন্তেকাল করেন তবে তার ওয়ারিশদের দায়িত্ব হল এ কুরবানী বাস্তবায়ন করা। তার ওয়ারিশগণ তা যবেহ করে নিজেরা খাবে, দান করবে ও উপটৌকন দিবে।
৪. নির্ধারিত পশুর থেকে কোন ধরনের উপকার ভোগ করা যাবে না।
যেমন- দুধ বিক্রি করতে পারবে না, কৃষিকাজে ব্যবহার করতে পারবে না, পশম বিক্রি করা যাবে না।
৫. কুরবানী দাতার অবহেলা বা অযত্নের কারনে যদি পশুটি ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়ে বা হারিয়ে যায় তবে তার কর্তব্য হবে অনুরূপ বা তার চেয়ে ভাল একটি পশু ক্রয় করা। আর যদি অবহেলা বা অযত্নের কারনে ত্রুটিযুক্ত না হয়ে অন্য কারনে হয় তবে ঐ পশুই কুরবানী করলে চলবে।
৬. যদি পশুটি হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায় আর কুরবানী দাতার উপর পূর্ব থেকেই কুরবানী ওয়াজিব হয়ে থাকে তাহলে সে কুরবানীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করবে। আর যদি পূর্ব থেকে ওয়াজিব ছিল না কিন্তু সে কুরবানীর নিয়তে পশু কিনে ফেলেছে তাহলে চুরি হয়ে গেলে বা মরে গেলে অথবা হারিয়ে গেলে তাকে আবার পশু কিনে কুরবানী করতে হবে।
৭. কুরবানীর পশুর কোন অংশ বিক্রয় করা বৈধ হবে না কারন তা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত বস্তু। তবে চামড়া বিক্রি করা যেতে পারে কিন্তু টাকা গরিবদেরকে দান করতে হবে। পশুর কোন অংশ দ্বারা কসাইকে পারিশ্রমিক দেয়া বৈধ নয়। যেহেতু সেটাও এক প্রকার বিনিময় যা ক্রয়-বিক্রয়ের মতো। সহীহ বুখারি, সহীহ মুসলিম। তার পারিশ্রমিক আলাদাভাবে প্রদান করতে হবে। অবশ্য কসাই গরিব হলে দান স্বরূপ গরিব না হলে হাদিয়া স্বরূপ তাকে কুরবানীর গোশত দেওয়া যায়।
৮. পশু ক্রয় করার পর যদি বাচ্চা হয়, তবে মায়ের সাথে তাকেও কুরবানী করতে হবে-তিরমিযী। এবং এর পূর্বে ঐ পশুর দুধ খাওয়া যাবে তবে শর্ত হল যেন ঐ বাচ্চা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। (বাইহাকী)
কোরবানির সময়
কুরবানী নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত একটি ইবাদাত। এ সময়ের পূর্বে যেমন কুরবানী আদায় হবে না তেমনি পরে করলেও আদায় হবে না। অবশ্য কাজা হিসাবে আদায় করলে ভিন্ন কথা। যারা ঈদের সালাত আদায় করবেন তাদের জন্য কুরবানীর সময় শুরু হবে ঈদের সালাত আদায় করার পর থেকে। যদি ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে কুরবানীর পশু যবেহ করা হয় তাহলে কুরবানী আদায় হবে না। আর কুরবানীর সময় শেষ হবে যিলহজ্জ মাসের তেরো তারিখ সূর্যাস্তের সাথে সাথে। অতএব কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় হল চারদিন, যিলহজ্জ মাসের দশ, এগার, বার, ও তেরো তারিখ।
মৃত ব্যক্তির পক্ষে কুরবানী
মূলত কুরবানী যথাসময়ে জীবিত ব্যক্তির তরফ থেকেই হওয়া উচিত। অবশ্য ইচ্ছা করলে তার সওয়াবে জীবিত অথবা মৃত আত্মীয়-স্বজনকেও শরিক করতে পারে। যেহেতু আমরা দেখি রাসুল (স) ও তার সাহাবীগণ নিজেদের ও পরিবার পরিজনদের তরফ থেকে কুরবানী করতেন। তবে আলাদাভাবে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করা বৈধ নয়। এর পক্ষে কোন সহীহ হাদিস নেই।
নিজের ও পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে কুরবানী
নিজ ও পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে কুরবানী করতে হবে। আয়েশা (রা) ও আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত যে, রাসুল (স) যখন কুরবানী দিতে ইচ্ছা করলেন তখন দুটো দুম্বা ক্রয় বরলেন। যা ছিল বড় হৃষ্টপুষ্ট, শিংওয়ালা, সাদাকালো বর্ণের এবং খাসি। একটি তিনি তার ঐ সকল উম্মতের জন্য কুরবানী করলেন যারা আল্লাহর একত্ববাদ ও তার রাসুলের রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে। অন্যটি তার নিজের ও পরিবারবর্গের জন্য কুরবানী করেছেন। (ইবনে মাজাহ)
নিজের ও পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশুই যথেষ্ট
এ বিষয়ে বর্ণিত হাদিসে মা আয়েশা (রা) বলেন, রাসুল (স) একটি শিংওয়ালা সুন্দর সাদাকালো দুম্বা আনতে বললেন, অতঃপর এ দুআ পড়লেন-
আল্লাহর নামে, হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ ও তার পরিবার-পরিজন এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করে নিন। এরপর উক্ত দুম্বা কুরবানী করলেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস সং ১৯৬৭)
সফরে থাকা অবস্থায় ভাগে কুরবানী-
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) বলেন, আমরা রাসুল (স) এর সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হল। তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরিক হলাম। (তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ।)
তবে একটি কথা বলা দরকার যে, মুকীম অবস্থায় অর্থাৎ বাড়ীতে অবস্থানকালে একটি পশুতে সাতটি পরিবার বা দশটি পরিবার অংশগ্রহণ করতে পারবে এর স্বপক্ষে কোন সহীহ হাদীস নেই।
কুরবানী দাতা যে সকল কাজ থেকে বিরত থাকবেন
উম্মু সালামাহ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স) বলেছেন,তোমাদের মাঝে যে কুরবানী করার ইচ্ছা করে সে যেন যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। ইমাম মুসলিম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তার অন্য একটি বর্ণনায় আছে সে যেন চুল ও চামড়া থেকে কোন কিছু স্পর্শ না করে। অন্য বর্ণনায় আছে, কুরবানীর পশু যবেহ করার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থায় থাকবে।
কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম
১. কুরবানীদাতা নিজের কুরবানীর পশু নিজেই যবেহ করবেন, যদি তিনি ভালভাবে যবেহ করতে পারেন। কেননা রাসুল (স) নিজেই যবেহ করেছেন। আর যবেহ করা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম। তাই প্রত্যেকের নিজের কুরবানী নিজে যবেহ করার চেষ্টা করা উচিত।
ইমাম বুখারী (র) বলেছেন, সাহাবী আবু মুসা আশআরী (রা) নিজের মেয়েদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন নিজ হাতে নিজেদের কুরবানীর পশু যবেহ করেন। (ফাতহুল বারী)। তার এ নির্দেশ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মেয়েরা কুরবানীর পশু যবেহ করতে পারেন। তবে কুরবানীর পশু যবেহ করার দায়িত্ব অন্যকে অর্পণ করা জায়েয আছে। কেননা সহীহ মুসলিমের হাদিসে এসেছে রাসুল (স) তেষট্টিটি কুরবানীর পশু নিজ হাতে যবেহ করে বাকিগুলো যবেহ করার দায়িত্ব আলী (রা) কে অর্পণ করেছেন। (সহীহ মুসলিম)
২. পশু যবেহ করার সময় তার সাথে সুন্দর আচরণ করা, দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করা জরুরি। এমন ব্যবস্থা নিয়ে যবেহ করা যাতে পশুর অধিক কষ্ট না হয় এবং সহজেই প্রাণ ত্যাগ করতে পারে। যবেহ যেন খুব তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরি দ্বারা করা হয় এবং তা খুবই শীঘ্রতা ও শক্তির সাথে যবেহ স্থলে পোঁচানো হয়।
শাদ্দাদ ইবনু আওস (রহঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে আমি দু’টি কথা মনে রেখেছি, তিনি বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের উপর ‘ইহসান’ অত্যাবশ্যক করেছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে, দয়ার্দ্রতার সঙ্গে হত্যা করবে; আর যখন জবাই করবে তখন দয়ার সঙ্গে জবাই করবে। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং তার জবাইকৃত জন্তুকে কষ্টে না ফেলে।
সহিহ মুসলিম: ৪৯৪৯
হাদিসের মান : সহিহ হাদিস
৩. উট দাঁড়ানো অবস্থায় এর ‘হলকুম’ বা কণ্ঠনালীর গোড়ায় কুরবানীর নিয়তে “বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লাহু আকবার” বলে অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করে ‘নহর’ করতে হয় এবং গরু বা ছাগলের মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে বাম কাতে ফেলে ‘যবেহ’ করতে হয়।
সুবুলুস সালাম, ৪/১৭৭ পৃঃ; মিরআত ২/৩৫১; ঐ, ৫/৭৫ পৃঃ।
কুরবানী দাতা ধারালো ছুরি নিয়ে কিবলামুখী হয়ে দুআ পড়ে নিজ হাতে খুব জলদি যবেহের কাজ সমাধা করবেন, যেন পশুর কষ্ট কম হয়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের ডান পা দিয়ে পশুর ঘাড় চেপে ধরতেন। যবেহকারী বাম হাত দ্বারা পশুর চোয়াল চেপে ধরতে পারেন।
নায়লুল আওত্বার ৬/২৪৫-৪৬ পৃঃ।
৪. প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোন অঙ্গ কেটে কষ্ট দেওয়া হারাম; যেমন ঘাড় মটকানো, পায়ের শিরা কাটা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি কাজ জান যাওয়ার আগে করা যাবে না।
কোরবানির পশু জবাই করার দোয়া
১. যবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ বলতে হবে। কারণ এটা বলা ওয়াজিব। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন, যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর। (সূরা আনআম -১১৮)
এবং যাতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি তা হতে তোমরা আহার কর না, এটা অবশ্যই পাপ। (সূরা আনআমঃ আয়াত নং-১২১)
আর নবী (স) বলেছেন, যা খুন বহায় এবং যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তা ভক্ষণ কর। (বুখারী, মুসলিম)
২. যবেহকালীন সময়ে বিসমিল্লাহ এর সাথে আল্লাহু আকবার যুক্ত করা মুস্তাহাব। জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
তিনি বলেন, ঈদুল আযহার দিন আমি রসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে ঈদগাহে উপস্থিত ছিলাম। তিনি খুত্ববাহ শেষে মিম্বার থেকে নামলেন। একটি বকরী আনা হলো। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ হাতে যবেহ করলেন এবং বললেনঃ بِسْمِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَرُ هَذَا عَنِّي وَعَمَّنْ لَمْ يُضَحِّ مِنْ أُمَّتِي বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবারু হাজা আন্নি ওয়া আম্মান লাম ইয়ুদাহহি মিন উম্মাতি (আল্লাহর নামে শুরু করছি, আল্লাহ মহান; এই কুরবানী আমার ও আমার উম্মাতের যারা কুরবানী করতে অক্ষম তাদের পক্ষ হতে)।
আবু দাউদ ২৮১০
হাদিসের মান : সহিহ হাদিস
৩. বিসমিল্লাহ এর সঙ্গে কবুল করার দুআ পড়া সুন্নাত। আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানী করার জন্য শিংওয়ালা দুম্বাটি আনতে নির্দেশ দেন- যেটি কালোর মধ্যে চলাফেরা করতো (অর্থাৎ- পায়ের গোড়া কালো ছিল), কালোর মধ্যে শুইতো (অর্থাৎ- পেটের নিচের অংশ কালো ছিল) এবং কালোর মধ্য দিয়ে দেখতো (অর্থাৎ- চোখের চারদিকে কালো ছিল)। সেটি আনা হলে তিনি আয়িশা (রাঃ)-কে বললেন, ছোরাটি নিয়ে এসো। অতঃপর বলেন, ওটা পাথরে ধার দাও। তিনি তা ধার দিলেন। পরে তিনি সেটি নিলেন এবং দুম্বাটি ধরে শোয়ালেন। তারপর সেটা যবেহ করলেন এবং বললেন- بِاسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন মুহাম্মাদীন ওয়া আলি মুহাম্মাদীন ওয়া মিন উম্মাতী মুহাম্মাদীন (আল্লাহর নামে; হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মদ ও তাঁর পরিবার এবং তাঁর উম্মতের পক্ষ হতে এটা কবুল করে নাও)।
মুসলিম ৪৯৮৫
হাদিসের মান : সহিহ হাদিস
কোরবানির গোশত বন্টনের নিয়ম
মহান আল্লাহ বলেন, অতঃপর তোমরা তা হতে আহার কর এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও। (সূরা হজ্জ-২৮)
রাসুল (স) কুরবানীর গোশত সম্পর্কে বলেন, তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর। (বুখারী, মুসলিম)
আহার করাও বাক্য দ্বারা অভাবগ্রস্তকে দান করা ও ধনীদের উপহার হিসাবে দেয়াকে বুঝায়।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজ পরিবারকে খাওয়াতেন ও এক ভাগ অভাবী প্রতিবেশীদের দিতেন এবং এক ভাগ সায়েল অর্থাৎ ফকির-মিসকিনদের মধ্যে ছাদাক্বা করতেন। (মিরআত ৫/১২০ পূঃ)।
অতএব কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজ পরিবারের খাওয়ার জন্য রাখবে, এক ভাগ অভাবী প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, ও বন্ধুবান্ধব যারা কুরবানী করতে পারেনি তাদেরকে হাদিয়া স্বরূপ দিবে এবং একভাগ সায়েল বা ফকির-মিসকিনদের মধ্যে ছাদাক্বা স্বরূপ বিতরণ করবে। প্রয়োজনে উক্ত বন্টনে কমবেশি করায় কোন দোষ নেই।
আল্লাহর নামে উৎসর্গকৃত কুরবানীর পবিত্র গোশত মুসলিমদের মধ্যেই বিতরণ করা উত্তম। তবে অমুসলিম প্রতিবেশী দুস্থ-অভাবীদের কিছু দেওয়ায় দোষ নেই। কেননা এটি যাকাত বহির্ভূত নফল ছাদাক্বার অন্তর্ভুক্ত। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ (রাঃ) তাঁর ইহুদী প্রতিবেশীকে দিয়ে গোশত বন্টন শুরু করেছিলেন।
বুখারী, আদাবুল মুফরাদ হা/১২৮, সনদ ছহীহ- আলবানী, ‘ইহুদী প্রতিবেশী’ অনুচ্ছেদ।
তাই কুরবানীর গোশত কাফেরকে তার অভাবের কারনে, আত্মীয় বা প্রতিবেশী হওয়ার কারনে অথবা তাকে ইসলামের প্রতি অনুরাগী করার জন্য দেওয়া বৈধ। আর তা ইসলামের এক মহানুভবতা।
তোমরা মুসলমানদের কুরবানী থেকে মুশরিকদের আহার করাইয়ো না’ মর্মে যে হাদীছ এসেছে সেটি ‘যঈফ’।
কুরবানীর গোশত যতদিন খুশি রেখে খাওয়া যায় । এমনকি ‘এক জিলহজ্জ থেকে আরেক যিলহজ্জ পর্যন্ত’ এক বছর।
আহমাদ হা/২৬৪৫৮ ‘সনদ হাসান’ তাফসীরে কুরতুবী হা/৪৪১৩।
তবে মহল্লায় অভাবীর সংখ্যা বেশি থাকলে বা দেশে ব্যাপক অভাব দেখা দিলে তিনদিনের পর গোশত সবটুকু বিতরণ করা যরূরী।
কোরবানীর গোশত বিক্রি করা নিষেধ তবে তার চামড়া বিক্রি করে ফকির মিসকিনকে দান করবে।
কোরবানীর পশু যবেহ করা কিংবা কোটা-বাছা বাবদ কুরবানীর গোশত বা চামড়ার পয়সা হতে কোনরূপ মজুরি দেওয়া যাবে না। সাহাবীগণ নিজ নিজ পকেট থেকে এই মজুরি দিতেন। অবশ্য ঐ ব্যক্তি দরিদ্র হলে হাদিয়া স্বরূপ তাকে কিছু দেওয়ায় দোষ নেই। (আল-মুগনী, ১১/১১০ পৃঃ)।