বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে আরাফার দিনের আমল, আরাফার দিনের দোয়া, আরাফার রোজার ফজিলত।
Table of Contents
Toggleআরাফার দিনের ফজিলত
আরাফাত দিবস হল এক মর্যাদাসম্পন্ন দিন। জিলহজ মাসের নবম তারিখকে আরাফাত দিবস বলা হয়। এ দিনটি অন্যান্য অনেক ফজিলত সম্পন্ন দিনের চেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী। যে সকল কারণে এ দিবসটির এত মর্যাদা তার কয়েকটি নীচে আলোচিত হল :
ইসলাম ধর্মের পূর্ণতা লাভ, বিশ্ব মুসলিমের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির দিন
ইমাম বুখারী রহ. তার নিজ সূত্রে তারিক বিন শিহাব রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে ইহুদীরা উমর রা.-কে বলল : আপনারা এমন একটি আয়াত তেলাওয়াত করে থাকেন যদি সে আয়াতটি আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হতো তাহলে আমরা সে দিনটিকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করতাম। উমর রা. এ কথা শুনে বললেন : আমি অবশ্যই জানি কখন তা অবতীর্ণ হয়েছে, কোথায় তা অবতীর্ণ হয়েছে, আর অবতীর্ণ হওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ স. কোথায় ছিলেন। হা, সে দিনটি হল আরাফাহ দিবস, আল্লাহর শপথ ! আমরা সে দিন আরাফাতের ময়দানে ছিলাম। আয়াতটি হলো : আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়েদা : ৩ নং আয়াত)।
বুখারী, ৪৬০৬
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে রজব রহ. সহ অনেক উলামায়ে কেরাম বলেছেন যে, এ আয়াত নাজিলের পূর্বে মুসলিমগণ ফরজ হিসেবে হজ আদায় করেননি। তাই হজ ফরজ হিসেবে আদায় করার মাধ্যমে দ্বীনে ইসলামের পাঁচটি ভিত্তি মজবুত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল।
লাতায়েফুল মাআরেফ : ইবনে রজব, পৃ-৪৮৬
ঈদের দিন সমূহের একটি দিন
আবু দাউদ সাহাবী আবু উমামা রা. থেকে বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : আরাফাহ দিবস, কোরবানির দিন, ও আইয়ামে তাশরীক (কোরবানি পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলামের অনুসারীদের ঈদের দিন। আর এ দিনগুলো খাওয়া-দাওয়ার দিন।
সহীহ সুনানে আবু দাউদ- ২১১৪
ইতিপূর্বে আলোচিত উমর রা. বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস রা. বলেন : সূরা মায়েদার এ আয়াতটি নাজিল হয়েছে দুটো ঈদের দিনে। তাহলো জুমার দিন ও আরাফাহ দিবস।
সহীহ সুনানে তিরমিজি- ২৪৩৮
এ হাদিস দুটো দ্বারা বুঝে আসে যে আরাফাহ দিবসকে ঈদের দিনের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়েছে।
আরাফাহ দিবসের রোজা দু বছরের কাফ্ফারা
সাহাবী আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ স.-কে আরাফাহ দিবসের সাওম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন : বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফ্ফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
মুসলিম-১১৬৩
গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের দিন
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. বলেন : আরাফার দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দার নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন : তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দাগণ আমার কাছে কি চায় ?
মুসলিম-১৩৪৮
ইমাম নববী রহ. বলেন : এ হাদীসটি আরাফাহ দিবসের ফজিলতের একটি স্পষ্ট প্রমাণ।
ইবনে আব্দুল বার বলেন : এ দিনে মোমিন বান্দারা ক্ষমা প্রাপ্ত হন। কেননা, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন গুনাহগারদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন না। তবে তওবা করার মাধ্যমে ক্ষমা-প্রাপ্তির পরই তা সম্ভব । হাদিসে আরো এসেছে:—
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলে কারীম স. বলেছেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরাফাতে অবস্থানকারীদের নিয়ে আসমানের অধিবাসীদের কাছে গর্ব করেন। বলেন : আমার এ সকল বান্দাদের দিকে চেয়ে দেখ ! তারা এলোমেলো কেশ ও ধুলোয় ধূসরিত হয়ে আমার কাছে এসেছে।
আহমদ ও হাকেম, হাদিসটি সহিহ
আরাফার দিনের আমল
রোজা পালন করা
সাহাবী আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ স. বলেন : আরাফার দিনের সওম আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।
মুসলিম- ১১৬৩
মনে রাখতে হবে আরাফার দিনে সওম তারাই রাখবেন যারা হজ পালনরত নন। যারা হজ পালনে রত তারা আরাফার দিবসে সওম পালন করবেন না।
আরাফার দিনে হজ পালনরত ব্যক্তি রাসূলে করীম স.-এর আদর্শ অনুসরণ করেই ঐ দিনের সওম পরিত্যাগ করবেন। যেন তিনি আরাফাতে অবস্থান কালীন সময়ে বেশি বেশি করে জিকির, দোয়াসহ অন্যান্য আমলে তৎপর থাকতে পারেন।
আর এদিনে শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলোকে সকল হারাম ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। হাদিসে এসেছে—
মুসনাদে আহমদে ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে যে, এ দিনে যে ব্যক্তি নিজ কান ও চোখের নিয়ন্ত্রণ করবে তাকে ক্ষমা করা হবে।
আহমদ ও হাকেম, হাদিসটি সহিহ
মনে রাখা দরকার যে শরীরের অঙ্গ সমূহ হারাম ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে হেফাজত করা যেমন সাওমের দাবি তেমনি হজেরও দাবি। কাজেই সর্বাবস্থায় এ দিনে এ বিষয়টির প্রতি যত্নবান হতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সঃ এর আদেশ বাস্তবায়ন ও নিষেধগুলোকে পরিহার করতে হবে।
অধিক পরিমাণে জিকির ও দোয়া করা
নবী করিম স. বলেছেন :—
সবচেয়ে উত্তম দোয়া হল আরাফাহ দিবসের দোয়া। আর সর্বশ্রেষ্ঠ কথা যা আমি বলি ও নবীগণ বলেছেন, তাহলো : لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির) অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মাবুদ নেই। তিনি একক তাঁর কোন শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই আর সকল প্রশংসা তারই প্রাপ্য, এবং তিনি সর্ব বিষয়ে শক্তিমান।
তিরমিজি- ২৮৩৭, মুয়াত্তা মালেক, হাদিসটি সহিহ
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্দুল বার বলেন : এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে আরাফা দিবসের দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হবে আর সর্বোত্তম জিকির হল লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
আত-তামহীদ : ইবনে আব্দুল বার
ইমাম খাত্তাবী বলেন : এ হাদিস দ্বারা বুঝে আসে যে, দোয়া করার সাথে সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রশংসা ও তার মহত্ত্বের ঘোষণা দেয়া উচিত।
উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করা
জিলহজ্জ মাসের ১ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহত্ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। এ তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদ, বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, বাজার সহ সর্বত্র পাঠ করা হবে। তবে মেয়েরা নিম্ন-স্বরে পাঠ করবে। তাকবীর হল :
لله أكبر الله أكبر لا إله إلا الله، والله أكبر الله أكبر ولله الحمد
আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।
যিলহজ মাসের এ তাকবীরের ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম বলেন : এ তাকবীর আদায়ের পদ্ধতি সাধারণত দু প্রকার।
(এক) আত-তাকবীরুল মুতলাক বা যে তাকবীর সর্বদা পাঠ করা যেতে পারে
এ তাকবীর যিলহজ মাসের শুরু থেকে ১৩ ই যিলহজ পর্যন্ত দিন রাতের যে কোন সময় পাঠ করা যেতে পারে।
আজকে আমাদের সমাজে এ সুন্নতটি পরিত্যাজ্য হয়েছে বলে মনে করা হয়। এর আমল দেখা যায় না। তাই আমাদের উচিত হবে এ সুন্নত এর প্রচলন করা। এতে তাকবীর বলার সওয়াব অর্জন হবে ও সাথে সাথে একটি মিটে যাওয়া সুন্নত জীবিত করার সওয়াব পাওয়া যাবে। হাদিসে এসেছে :—
রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : আমার ইন্তেকালের পরে যে সুন্নত এর মৃত্যু হয়েছে তা যে জীবিত করবে সে ব্যক্তি এ সুন্নত আমলকারীদের সওয়াবের পরিমাণ সওয়াব পাবে এবং তাতে আমলকারীদের সওয়াবে কোন অংশে কম হবে না।
তিরমিজি-৬৭৭ ও ইবনে মাজাহ- ২০৯, হাদিসটি সহিহ
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও আবু হুরাইরা রা. জিলহজ মাসের প্রথম দশকে বাজারে যেতেন ও তাকবীর পাঠ করতেন, লোকজনও তাদের অনুসরণ করে তাকবীর পাঠ করতেন।
বুখারী, ঈদ অধ্যায়
অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল স.-এর এই দুই প্রিয় সাহাবী লোকজনকে তাকবীর পাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।
মনে রাখতে হবে উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। কিন্তু সকলে একই আওয়াজে জামাতের সাথে তাকবীর পাঠ করবে না। কারণ এটা বেদআত। যেমন একজন বলল : ‘আল্লাহু আকবার’। সকলে বলল : ‘আল্লাহু আকবার’। কেননা, রাসূলুল্লাহ স. বা সাহাবায়ে কেরাম কখনো এরূপ করেননি। তবে সকলে একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন আওয়াজে তাকবীর পাঠ করতে পারবেন। তবে কাউকে তাকবীর শেখানোর জন্য এ রূপ করা হলে তার কথা আলাদা।
সতর্ক থাকতে হবে যে, আমরা কোন সুন্নত আদায় করতে যেয়ে যেন বিদআতে লিপ্ত হয়ে না পড়ি। আল্লাহর রাসূল স. ও তার সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে সুন্নত সমূহ আদায় করেছেন আমাদের তেমনই করতে হবে। এটাই হল আল্লাহর রাসূলের যথার্থ অনুসরণ। আমরা যদি সে সুন্নত আদায় করতে গিয়ে সামান্যতম ভিন্ন পদ্ধতি চালু করি তাহলে তা বিদআত বলে গণ্য হবে। হাদিসে এসেছে—
রাসূলে কারীম স. বলেছেন : যে ব্যক্তি এমন কাজ করল যার প্রতি আমাদের (ইসলামের) নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।
বুখারী-২৬৯৮, মুসলিম- ১৭১৮
(দুই) আত-তাকবীরুল মুকাইয়াদ বা বিশেষ সময়ের তাকবীর
সেটা হল ঐ তাকবীর যা সালাতের পরে আদায় করা হয়ে থাকে। এ দ্বিতীয় প্রকার তাকবীর যা সালাতের পরে পাঠ করা হয়ে থাকে তা যিলহজ মাসের নবম তারিখ থেকে মিনার শেষ দিন অর্থাৎ ১৩ তারিখ পর্যন্ত পাঠ করতে হয়।