বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; ইমাম মাহদীর আগমন সম্পর্কিত যেসব বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে; সেগুলো নিরসন করে; সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া আজকের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য। প্রথমে আলোচনা করব মাহদির পরিচয় সম্পর্কে। তারপর তার আগমনের ব্যাপারে কি কি বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, সে ব্যাপারে কথা বলব; এবং বিভ্রান্তিগুলো নিরসন করব। সর্বশেষে ইমাম মাহদীর আগমনের হাদিসগুলির আলোকে তার আগমনের পূর্বে কি কি ঘটনা ঘটবে; কি কি নিদর্শন প্রকাশিত হবে; সেগুলোকে যথাসম্ভব পরযায়ক্রমে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
Table of Contents
Toggleইমাম মাহদীর পরিচয়
মাহদী অর্থ পথ প্রদর্শিত ব্যক্তি; এটি তার মূল নাম নয়; তার নাম হবে নবী (স) এর নামে; অর্থাৎ মুহাম্মাদ বা আহমাদ। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে পথ প্রদর্শিত হবেন; তাই তাকে মাহদী নামে ডাকা হবে; তার পিতার নাম হবে নবী স. এর পিতার নামে অর্থাৎ আব্দুল্লাহ; তিনি নবী স. এর বংশে ফাতেমার সন্তান হাসান এর ঔরস থেকে জন্মলাভ করবেন; চেহারা ও দৈহিক গঠন নবী স.এর মত হবে না; তিনি উজ্জল ও প্রশস্ত ললাটের অধীকারী এবং সুউচ্চ নাসিকাবিশিষ্ট হবেন; স্বভাব চরিত্রে তিনি নবী স. এর ন্যায় হবেন; তিনি বায়তুল্লাহতে বায়আত গ্রহণ করবেন। তিনি সারাবিশ্বকে ন্যায়নিষ্ঠা ও ইনসাফে ভরে দিবেন; যেমনভাবে ইতিপূর্বে জুলুম ও অত্যাচারে ভরে দেয়া হয়েছিল। তিনি পাঁচবছর অথবা সাতবছর অথবা নয়বছর বিশ্বকে শাসন করবেন।
ইমাম মাহদীর আগমন সম্পর্কে বিভ্রান্তি নিরসন
এসব ব্যাপারে আসলে কোন মতপার্থক্য নেই; বিভ্রান্তি হল তিনি কবে আসবেন সেই ব্যাপারে; এই ব্যাপারে কুরআনে বা হাদিসে স্পষ্ট কোন কিছু বর্ণিত হয়নি। তিনি কবে আসবেন সেটা একমাত্র আল্লাহই জানেন; সুতরাং দিন তারিখ বা সাল নির্ধারণ করা আমাদের কাজ নয়। ইমাম মাহদীর আগমন হচ্ছে কিয়ামতের একটি বড় আলামত; কিয়ামতের পূর্ব মূহুর্তে তিনি আগমন করবেন। কিয়ামত কবে হবে তা আমরা জানি না এবং এও জানি না যে; ইমাম মাহদী কবে আসবেন। অনেকেই বলছে যে, ২০২৬ সালে ইমাম মাহদীর আগমনের খুব সম্ভাবনা রয়েছে; যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে তারা এ কথা বলছে; সে বিষয়ে পরে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। বেশি ব্যস্ততা দেখানোর কোন প্রয়োজন নেই; যখন আল্লাহ ইচ্ছা করবেন তখনই তিনি মাহদীকে প্রেরণ করবেন।
আজ যারা এই বিষয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে; তারা না আবার ইমাম মাহদী চলে আসলে তাকে অস্বীকার করে বসে। তিনি কবে আসবেন এটা মূল বিষয় নয়; মূল বিষয় হল, তিনি আত্মপ্রকাশ করলে আমাদেরকে তার সাথে মিলিত হতে হবে; এর জন্য আমাদেরকে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে সর্বদিক থেকে; কারন তিনি যেকোন সময় আগমন করতে পারেন। তাই আমাদের কাজ হল জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়া; বিশেষকরে দাজ্জালের কথা বেশিবেশি আলোচনা করা। কারন ইমাম মাহদীর আগমনের কয়েকবছর পরেই দাজ্জালের আবির্ভাব হবে; আর সেটাই হবে উম্মতের সবচেয়ে বড় ফিৎনা। আবার অনেকেই বলছে, ইমাম মাহদী চলে এসেছে। এ পর্যন্ত অনেকেই চলে গেছে যারা ইমাম মাহদী দাবী করেছিল। এখনও অনেকেই দাবী করছে । এসব গুজবে কান দেয়া মুমিনের কাজ নয়। কারন ইমাম মাহদী যখন আগমন করবেন তখন আল্লাহ তায়ালা খুব ভালভাবেই মানুষের মাঝে এই সংবাদ পৌছে দিবেন।
ইমাম মাহদী আগমনের আলামত
এখন আলোচনা করব ইমাম মাহদীর আগমনের পূর্বে কিকি ঘটনা ঘটবে, কি কি নিদর্শন প্রকাশিত হবে। যথাসম্ভব ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
১. সারা পৃথিবী ফিৎনায় পতিত হবে
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, চতুর্থ ফিৎনা হচ্ছে অন্ধকার অন্ধত্বপূর্ণ ফিৎনা, যা সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় উত্তাল হয়ে আসবে। আরব অনারবের কোন ঘর বাকি থাকবে না। প্রত্যেক ঘরেই উক্ত ফিৎনা প্রবেশ করবে। যা দ্বারা তারা লাঞ্ছিত অপদস্থ হয়ে যাবে। যে ফিৎনাটি শাম দেশে চক্কর দিতে থাকলেও রাত্রিযাপন করবে ইরাকে। তার হাত পা দ্বারা আরব ভূখন্ডের ভিতরে বিচরণ করতে থাকবে। উক্ত ফিৎনা এ উম্মতের সাথে চামড়ার সাথে চামড়া মিশ্রিত হওয়ার ন্যায় মিশ্রিত হয়ে যাবে।
তখন বালা মুসিবত এত ব্যাপক ও মারাত্মক আকার ধারণ করবে যা দ্বারা মানুষ ভালো খারাপ নির্ণয় করতে সক্ষম হবে না। ঐ মুহুর্তে কেউ উক্ত ফিৎনা থামানোরও সাহস রাখবে না। একদিকে একটু শান্তির সুবাতাস বইলেও অন্যদিকে তীব্র আকার ধারন করবে। সকালে কেউ মুসলমান থাকলেও সন্ধা হতে হতে সে কাফের হয়ে যাবে। উক্ত ফিৎনা থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না। কিন্তু শুধু ঐ লোক বাঁচতে পারবে যে সমুদ্রে ডুবন্ত ব্যক্তির ন্যায় করুন সুরে আকুতি জানাতে থাকবে। সেটা প্রায় বার বছর পরযন্ত স্থায়ী থাকবে। এক পরযায়ে সকলের কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
২. মুসলিমদের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে
হযরত জাবের (রা) বলেন, ঐ সময় খুব নিকটবর্তী যখন ইরাকবাসীদের কাছে ধনসম্পদ বা খাদ্যদ্রব্য পৌছার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। জিজ্ঞাসা করা হয়, কাদের পক্ষ থেকে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে ? বললেন অনারবদের পক্ষ থেকে। অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে পুনরায় বলতে লাগলেন, ঐ সময়ও খুব নিকটবর্তী, যখন শামবাসীদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। জিজ্ঞাসা করা হল, এটা তাহলে কার পক্ষ থেকে করা হবে ? বললেন, রূমক (পশ্চিমা) দের পক্ষ থেকে করা হবে। অতঃপর বলেন যে, নবী করীম (স) এরশাদ করেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে একজন খলীফা হবে, যে মানুষকে দুহাত ভরে ধনসম্পদ প্রদান করবে, কোন হিসাব করবে না। রাসুল (স) আরও বলেন যে, ঐ সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ নিহিত ! অবশ্যই ইসলাম তার প্রাথমিক অবস্থার দিকে ফিরে আসবে, ঠিক যেমনভাবে মদীনা থেকে সূচনা হয়েছিল। এমনকি পরিপূর্ণ ঈমান শুধু মদীনার গন্ডির ভেতরেই রয়ে যাবে।
হযরত আবু সালেহ (তাবেয়ী) আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেন যে, মিসরের উপরও অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
ফায়সালা: ইরাকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ভবিষ্যদ্বাণীটি বাস্তবায়িত হয়েছে। সুতরাং হে ঈমানদারগণ ! এখনও কিবসে থাকার সময় রয়েছে ?
৩. শাম থেকে সুফিয়ানী নামক এক ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটবে
শাম হচ্ছে বর্তমান জর্ডান, ফিলিস্তিন, ইসরাইল, সিরিয়া, লেবানন। উক্ত এলাকা থেকে সে আত্মপ্রকাশ করবে; অতঃপর সে কুফার দিকে রওয়ানা হবে। তখন সে মদীনার দিকে একটি বাহিনী প্রেরণ করবে। অতঃপর তারা এসে যুদ্ধ করতে থাকবে, যতদিন আল্লাহ চান এমনকি মায়ের পেট ফেড়ে বাচ্চাটিকেও পরযন্ত হত্যা করে দেবে। সে গর্ভধারণকাল পরিমাণ শাসক পদে অধিষ্ঠিত থাকবে। তার নাম হবে আযহার বিন কালবীয়্যা অথবা যুহরী বিন কালবীয়্যা। সে সুফিয়ানী নামে প্রসিদ্ধ থাকবে। সে বড় মাথা বিশিষ্ট এবং অত্যন্ত বিশ্রী চেহারার অধিকারী হবে।
৪. পবিত্র আত্মাকে শহিদ করে দেয়া হবে
৫. প্রতি নয় জনে এক জনকে কতল করে দেয়া হবে
৬. যে বছর সূর্যও চন্দ্র গ্রহণ রমযান মাসেই হবে সে বছর ইমাম মাহদীর আগমন ঘটবে
এমন ঘটনা আসমান ও জমিন সৃষ্টির পর থেকে কখনই ঘটেনি। রমযানের প্রথমদিকে সূর্যগ্রহণ শেষদিকে চন্দ্রগ্রহণ হবে। অনেকেই একথা বলছে যে, ২০২৬ সালে এ ঘটনা ঘটবে। কিন্তু তাদের দাবীতে একটু ভূল হয়েছে, কারন তাদের ভাষ্যমতেই রমযান শুরু হওয়ার একদিন আগে সূরযগ্রহন ঘটবে। তাহলে হিসাবটা কি দাড়াচ্ছে?
৭. রমযান মাসে এক ভয়ানক বিকট আওয়াজ শোনা যাবে
হযরত ফিরোজ দাইলামী রা. থেকে বর্ণিত নবী করীম স. এরশাদ করেন- রমযান মাসে একটি বিকট আওয়াজ হবে। সাহাবায়ে কেরাম রা. বললেন- রমযানের শুরুতে? মাঝে? নাকি শেষে? উত্তরে বললেন- বরং রমযানের মাঝামাঝিতে। যখন ১৫ই রমযানের রাত্রিটি জুমার রাত্রি হবে, তখন আসমান থেকে একটি বিকট আওয়াজ আসবে। এই আওয়াজ শুনে সত্তর হাজার লোক তৎক্ষণাৎ বেহুশ হয়ে যাবে। অন্য সত্তর হাজার লোক বোবা হয়ে যাবে। অপর সত্তর হাজার অন্ধ হয়ে যাবে। সত্তর হাজার বধির হয়ে যাবে। সত্তর হাজার বোবা হয়ে যাবে। সত্তর হাজার নারীর কুমারীত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন- তাহলে উম্মতের মধ্যে কারা বাঁচতে সক্ষম হবে? উত্তরে বললেন- যারা নিজেদের ঘরে অবস্থান করে সিজদায় গিয়ে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে। এবং স্বজোরে তাকবীর তথা আল্লাহু আকবার বলতে থাকবে। এরপর আরেকটি আওয়াজ আসবে। প্রথম আওয়াজটি হবে জিবরাঈলের। দ্বিতীয় আওয়াজটি হবে শয়তানের।
৮. খনিজ ভান্ডারের কাছে শাসকের তিন পুত্র যুদ্ধ করবে। খনিজ ভান্ডার কারো কাছেই স্থানান্তরিত হবে না
৯. পূর্বদিক থেকে কালো ঝান্ডাবাহী লোকেরা আগমন করবে
তারা এদের বিরুদ্ধে এত কঠোরভাবে যুদ্ধ করবে যে, এমন যুদ্ধ ইতিপূর্বে কেউ করতে সক্ষম হয়নি।
১০. যিলকাদ মাসে কোন আরব বাদশার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মতানৈক্য দেখা দেবে
আরব সম্প্রদায় গোত্রে গোত্রে বিভক্ত হয়ে পড়বে। ফলে তাদের মাঝে পারস্পরিক অনেক সংঘর্ষের সূত্রপাত হবে।
১১. যিলহজ্ব মাসে প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গে দেয়া হবে
ফলশ্রুতিতে হাজীদেরকে লূট করা হবে। মিনা প্রান্তরে যুদ্ধ সংঘটিত হবে। তাতে প্রচুর পরিমাণে হত্যাযজ্ঞ হবে। রক্তের বন্যা বয়ে যাবে। শেষপরযন্ত আকবাতুল জামরাতেও রক্ত বইতে থাকবে। পরিস্থিতি এই পরযন্ত পৌছবে যে, তাদের সাথী ইমাম মাহদী পালিয়ে মক্কায় চলে যাবেন।
১২. মুহাররম মাসের প্রথম দিনগুলি হবে উম্মতের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ
আর শেষ দিনগুলি হবে মুক্তির দিন। তখনই কাবা শরিফের রুকন এবং মাকামে ইব্রাহীমের মাঝামাঝি স্থানে ইমাম মাহদীর হাতে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেবায়আত করা হবে। তাকে বলা হবে যে, আপনি আমাদের বায়আত নিতে অস্বীকার করলে আমরা আপনার গর্দান উড়িয়ে দেব। অতঃপর বদর যুদ্ধাদের সংখ্যা পরিমাণ (৩১৩) জন লোক উনার হাতে বায়আত গ্রহণ করবে। তাদের প্রতি আসমান ও জমিনের বাসিন্দাগণ সকলেই খুশি থাকবে।