বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর প্রতি ওহী নাযিলের পদ্ধতি কয়টি ও কি কি।
ওহী নাযিলের পদ্ধতি কয়টি ও কি কি?
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিভিন্ন পদ্ধতিতে ওহী নাযিল হত। পদ্ধতিগুলো নিচে বর্ণনা করা হলোঃ-
ওহী নাযিলের প্রথম পদ্ধতি
সহীহ বুখারীর এক হাদীসে আছে, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ.) বলেন, একবার হারিছ ইবনে হিশাম (রাঃ.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কাছে ওহী কিভাবে আসে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কখনো আমি ঘণ্টাধ্বনির মত শুনতে পাই আর ওহীর এ পদ্ধতিই আমার পক্ষে সর্বাপেক্ষা কঠিন। অতঃপর এ অবস্থা আমার থেকে কেটে যায়, আর ইতোমধ্যে যা-কিছু সে ধ্বনিতে আমাকে বলা হয়, তা আমার মুখস্থ হয়ে যায়। কখনও ফিরিশতা আমার সামনে একজন পুরুষের আকৃতিতে উপস্থিত হয়। (বুখারী, ১ম খণ্ড, ২ পৃষ্ঠা)
এ হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহীর আওয়াজকে ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে তুলনা করেছেন। শায়খ মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী (রহ.) এর ব্যাখ্যা করেন যে, এক তো ওহীর আওয়াজ ঘণ্টাধ্বনির মত অবিরাম হত, মাঝখানে ছেদ ঘটত না, দ্বিতীয়ত ঘণ্টা যখন একাধারে বাজতে থাকে, তখন শ্রোতার পক্ষে সে ধ্বনি কোন্ দিক থেকে আসছে তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। তার কাছে মনে হয় সে ধ্বনি সকল দিক থেকেই আসছে। আল্লাহ তাআলার কালামেরও এটা এক বৈশিষ্ট্য যে, তার বিশেষ কোন দিক থাকে না; বরং সকল দিক থেকেই তার ধ্বনি শ্রুতিগোচর হয়। এর স্বরূপ তো চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা ছাড়া উপলব্ধি করা সম্ভব নয়, তবে বিষয়টিকে সাধারণের উপলব্ধির অনেকটা কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। (ফয়জুল বারী, ১ম খন্ড, ১৯-২০ পৃষ্ঠা)
এ পদ্ধতিতে ওহী নাযিল হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর তার চাপ বড় বেশি পড়ত। হযরত আয়েশা (রাঃ) এ হাদীসেরই শেষাংশে বলেন, আমি তীব্র শীতের দিনে তার প্রতি ওহী নাযিল হতে দেখেছি। যখন নাযিল শেষ হত, তখন সেই কঠিন শীতের সময়ও তাঁর পবিত্র ললাট ঘর্মাক্ত হয়ে যেত।
অপর এক বর্ণনায় হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন,
যখন ওহী নাযিল হত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে আসত, পবিত্র চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে খেজুর ডালার মত হলদে হয়ে যেত, সামনের দাঁত শীতে কাঁপতে থাকত এবং তিনি এতটা ঘর্মাক্ত হয়ে পড়তেন যে, তার ফোটা সমূহ মুক্তার মত চকচক করত। (আল-ইতকান, ১ম খন্ড, ৪৬ পৃষ্ঠা)
ওহী নাযিলের এ অবস্থায় কখনো কখনো চাপ এতটা বেশি হত যে, তিনি তখন যে পশুর পিঠে সওয়ার থাকতেন, সেটা তার গুরুভারের কারণে বসে পড়ত। একবারের কথা- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ.)-এর উরুতে মাথা রেখে শোয়া ছিলেন। এ অবস্থায় ওহী নাযিল হল। তাতে হযরত যায়েদ (রাঃ)-এর উরুতে এতটা চাপ পড়ল যে, তা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল। (যাদুল মাআদ, ১ম খণ্ড, ১৮-১৯ পৃষ্ঠা)
কখনও কখনও ওহীর মৃদু আওয়াজ অন্যরাও উপলব্ধি করতে পারত। হযরত উমর (রাযি.) বলেন, যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ওহী নাযিল হত, তখন তাঁর পবিত্র চেহারার কাছে মৌমাছির গুনগুন আওয়াজের মত শব্দ শোনা যেত। (মুসনাদে আহমদ, কিতাবুস সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ, ২০ খণ্ড, ২১২ পৃষ্ঠা)
ওহী নাযিলের দ্বিতীয় পদ্ধতি
ফিরিশতা কোন মানুষের আকৃতিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে আল্লাহ তাআলার বাণী পৌঁছে দিত। এরূপ ক্ষেত্রে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম সাধারণত প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত দিয়া কালবী (রাঃ.)-এর আকৃতিতে আগমন করতেন। কখনো অন্য কারও বেশেও আসতেন। সে যাই হোক, জিবরাঈল আলাইহিস সালাম যখন কোন মানবাকৃতিতে ওহী নিয়ে আসতেন, তখনকার ওহী নাযিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে সর্বাপেক্ষা সহজ হত। (আল-ইতকান, ১ম খণ্ড, ৪৬ পৃষ্ঠা)
ওহী নাযিলের তৃতীয় পদ্ধতি
হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম কোন মানবাকৃতি ধারণ না করে বরং তার আসল আকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করতেন। তবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সারাটা জীবনে এরূপ মাত্র তিনবারই হয়েছে। একবার সেই সময়, যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে তার আসল চেহারায় দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। দ্বিতীয়বার মিরাজে আর তৃতীয়বার নবুওয়াতের শুরুভাগে মক্কা মুকাররমার আওয়াদ নামক স্থানে। প্রথম দু’বারের কথা তো সহীহ সনদেই বর্ণিত আছে, তবে তৃতীয়বারের ঘটনা সনদের দিক থেকে দুর্বল হওয়ায় কিছুটা সন্দেহযুক্ত। (ফাতহুল বারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮-১৯)
ওহী নাযিলের চতুর্থ পদ্ধতি
চতুর্থ পদ্ধতি হল কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথোপকথন। জাগ্রত অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সৌভাগ্য একবার অর্থাৎ মেরাজে লাভ করেছিলেন। তাছাড়া স্বপ্নযোগেও আল্লাহ তাআলার সঙ্গে তাঁর একবার কথোপকথন হয়েছিল। (আল-ইতকান, ১ম খন্ড, ৪৬ পৃষ্ঠা)
ওহী নাযিলের পঞ্চম পদ্ধতি
ওহী নাযিলের পঞ্চম পদ্ধতি ছিল এই যে, হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম কোনও আকৃতিতে সামনে আসা ছাড়াই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্তরে কোন কথা ঢেলে দিতেন। (প্রাগুক্ত)