শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

Table of Content

  1. শবে বরাতের রোজা কয়টি
  2. কিছু সনদ বিহীন বানোয়াট কথা
  3. প্রচলিত আরো কিছু ভিত্তিহীন কথা
  4. সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতামত ও কর্ম
  5. চার ইমাম ও অন্যান্য ফকীহদের মতামত
  6. শবে বরাতের হাদিস গুলোর প্রতিপাদ্য
  7. মুমিন জীবনের প্রতিটি রাতই শবে বরাত

কিছু সনদ বিহীন বানোয়াট কথা

পূর্বে আমরা মধ্য-শাবানের রাত্রি সম্পর্কে বর্ণিত সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস গুলি আলোচনা করেছি। এগুলি বিভিন্ন সনদে হাদীসের গ্রন্থ সমূহ সংকলিত হয়েছে এবং মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে এগুলোর গ্রহণযোগ্যতার পর্যায় নির্ধারণ করেছেন। এগুলো ছাড়াও আমাদের সমাজে শবে বরাত বিষয়ে আরো কিছু কথা হাদীস নামে প্রচলিত, যেগুলির কোনরূপ কোন সনদ বা ভিত্তি পাওয়া যায় না। যে হাদীসের সনদ আছে তা নিরীক্ষার মাধ্যমে সহীহ, যয়ীফ বা জাল বলে নির্ধারণ করেছেন মুহাদ্দিসগণ। আর যে হাদীসের কোনোরূপ সনদই পাওয়া যায় না, কেবল লোকমুখে হাদীস বলে প্রচলিত, তা সন্দেহাতীতভাবে জাল ও ভিত্তিহীন বলে গণ্য। এ জাতীয় কিছু কথা উল্লেখ করছি।

১. শবে বরাতের গোসল

প্রচলিত সনদ-বিহীন কথাগুলির অন্যতম হলাে এ রাতে গোসল করার ফযীলত। বিষয়টি যদিও ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা, তবুও আমাদের সমাজে তা ব্যাপক প্রচলিত। আমাদের দেশের প্রচলিত প্রায় সকল পুস্তকেই এ জাল কথাটি লিখা হয় এবং ওয়াযে আলোচনায় বলা হয়। প্রচলিত একটি বই থেকে উদ্ধৃত করছি: একটি হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি উক্ত রাত্রিতে এবাদতের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় গোসল করবে, সে ব্যক্তির গোসলের প্রত্যেকটি বিন্দু পানির পরিবর্তে তাদের আমল নামায় ৭০০ রাকাত নফল নামাজের সওয়াব লিখা যাইবে। গোসল করিয়া দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল অজুর নামাজ পড়িবে।

এ মিথ্যা কথাটি দ্বারা প্রভাবিত ও প্রতারিত হয়ে কঠিন শীতের রাতেও অনেকে গোসল করেন। উপরন্তু ফোটা ফোটা পানি পড়ার আশায় শরীর ও মাথা ভালো করে মােছেন না। এর ফলে অনেকে, বিশেষত, মহিলারা ঠান্ডা-সর্দিতে আক্রান্ত হন। আর এ কষ্ট শরীয়তের দৃষ্টিতে বেকার পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছুই নয়। বরং বিদআত।

২. শবে বরাতে হালুয়া রুটি

এ রাত্রিতে হালুয়া-রুটি তৈরি করা, খাওয়া, বিতরণ করা ইত্যাদি সবই বানােয়াট ও ভিত্তিহীন কর্ম। এ রাত্রিতে এ সকল কর্ম করলে কোনাে বিশেষ সাওয়াব পাওয়া যাবে মর্মে কোনাে হাদীস বর্ণিত হয় নি। মুর্খ লােকেরা বলে যে, রাসূলুল্লাহ সঃ যখন উহুদ যুদ্ধে আহত হন এবং তার মুবারক দাঁত ভেঙ্গে যায় তখন তিনি হালুয়া খেয়েছিলেন। এজন্য শবে বরাতে হালুয়া বানাতে হয়। কথাটি একেবারেই ভুল। আর উহদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল শাওয়াল মাসে।

৩. শবে বরাতের রোজা

প্রতি আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে সিয়াম পালন সুন্নাত নির্দেশিত গুরুত্বপূর্ণ নফল ইবাদত। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শাবান মাসে বেশি বেশি সিয়াম পালন করতেন। সাধারণত তিনি শাবানের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত রোজা রাখতেন এবং অনেক সময় প্রায় পুরো শাবানই সিয়ামরত থাকতেন। এজন্য শাবানের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ অথবা অন্তত ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ সিয়াম পালন সুন্নাত সম্মত গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল। তবে শুধু ১৫ই শাবান সিয়াম পালনের বিষয়ে কোনাে গ্রহণযােগ্য হাদীস পাওয়া যায় না।

আলী (রা) থেকে বর্ণিত (১৭ নং) হাদীসে এ দিনে সিয়ামের কথা বলা হয়েছে। তবে হাদিসটির সনদ নির্ভরযোগ্য নয়। ১৪ রাকাত বিষয়ক (৩২ নং) হাদীসেও সিয়াম পালনের ফযীলত উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু হাদীসটি জাল। এ বিষয়ক আরেকটি সনদবিহীন কথা: যে ব্যক্তি শাবান মাসের ১৫ তারিখে সিয়াম পালন করবে, জাহান্নামের আগুন কখনােই তাকে স্পর্শ করবে না।

প্রচলিত আরো কিছু ভিত্তিহীন কথা

আমাদের দেশে প্রচলিত পুস্তকাদিতে অনেক সময় লেখকগণ বিশুদ্ধ ও অশুদ্ধকে একসাথে মিশ্রিত করেন। অনেক সময় সহীহ হাদীসেরও অনুবাদে অনেক বিষয় প্রবেশ করান যা হাদীসের নামে মিথ্যায় পরিণত হয়। অনেক সময় নিজেদের খেয়াল-খুশি মত বুখারী, মুসলিম ইত্যাদি গ্রন্থের নাম ব্যবহার করেন। এগুলির বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। মহান আল্লাহ দয়া করে আমাদের লেখকগণের পরিশ্রম কবুল করুন, তাদের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করুন এবং আমাদের সকলকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফিক দান করুন। শবে বরাত বিষয়ক কিছু ভিত্তিহীন কথা আমাদের দেশে প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি। প্রায় সকল পুস্তকেই এই কথাগুলো কম বেশি লেখা হয়েছে।

হাদিসে আছে, যাহারা এই রাত্রিতে ইবাদত করবে আল্লাহ তাআলা আপন খাছ রহমত ও স্বীয় অনুগ্রহের দ্বারা তাদের শরীরকে দোজখের আগুনের উপর হারাম করিয়া দিবেন। অর্থাৎ তাহাদিগকে কখনো দোযখে নিক্ষেপ করিবেন না। হযরত সঃ আরও বলেন- আমি জিবরাঈল (আঃ) এর নিকট শুনিয়াছি, যাহারা শাবানের চাদের ১৫ তারিখ রাত্রিতে জাগিয়া ইবাদত বন্দেগী করিবে, তাহার শবে কদরের ইবাদতের সমতুল্য ছাওয়াব পাইবে।

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

আরও একটি হাদীসে আছে, হযরত (সঃ) বলিয়াছেন, শাবানের চাদের ১৫ তারিখের রাত্রিতে এবাদতকারী আলেম, ফাজিল, অলি, গাউস, কুতুব, ফকির, দরবেশ, ছিদ্দীক, শহীদ, পাপী ও নিস্পাপ সমস্তকে আল্লাহ তাআলা মার্জনা করিবেন। কিন্তু যাদুকর, গণক, বখিল, শরাবখাের, যেনাকারী, নেশাখোর ও পিতা-মাতাকে কষ্ট দাতা এই কয়জনকে আল্লাহ তাআলা মাফ করবেন না।

আরও একটি হাদীসে আছে, আল্লাহ তাআলা শাবানের চাদের ১৫ তারিখের রাত্রিতে ৩০০ খাছ রহমতের দরজা খুলিয়া দেন ও তার বান্দাদের উপর বেশুমার রহমত বর্ষণ করতে থাকেন।

কালইউবি কিতাবে লিখিত আছে, একদিন হযরত ঈসা (আ) জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন হে খোদাতালা! এ জামানায় আমার চেয়ে বুজুর্গ আর কেহ আছে কি? তদুত্তরে আল্লাহ তাআলা বলিলেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। সম্মুখে একটু গিয়াই দেখ। ইহা শুনিয়া ঈসা (আ) সম্মুখের দিকে চলিতে লাগিলেন, তখন বৃদ্ধ বললেন, আমি এতদ্দেশীয় একজন লােক ছিলাম। আমার মাতার দোয়ায় আল্লাহ তাআলা আমাকে এই বুযুর্গী দিয়াছেন। সুতরাং আজ ৪০০ বৎসর ধরিয়া আমি এই পাথরের ভিতরে বসিয়া খোদা তাআলার ইবাদত করতেছি এবং প্রত্যহ আমার আহারের জন্য খোদা তাআলা বেহেশত হইতে একটি ফল পাঠাইয়া থাকেন। ইহা শুনিয়া হযরত ঈসা (আঃ) সিজদায় পড়িয়া কাঁদিতে লাগিলেন।

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

তখন আল্লাহ তাআলা বলিলেন, হে ঈসা (আ)! জানিয়া রাখ যে, শেষ জামানার নবীর উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি শাবানের চাদের পনরই তারিখের রাত্রে ইবাদত বন্দেগী করিবে ও সেদিন রোজা রাখিবে নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি আমার নিকট এই বৃদ্ধের চেয়েও বেশি বুযুর্গ এবং প্রিয় হইতে পারিবে। তখন ঈসা (আ) কাদিয়া বলিলেন, হে খোদা তাআলা! তুমি আমাকে যদি নবী না করিয়া আখেরী জামানার নবীর উম্মত করিতে তাহা হইলে আমার কতই না সৌভাগ্য হইত! যেহেতু তাহার উম্মত হইয়া এক রাত্রিতে এত সওয়াব কামাই করিতে পারিতাম। 

হাদীসে আছে, শাবানের চাঁদের চৌদ্দ তারিখের সূর্য অস্ত যাইবার সময় এই দোয়া (লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ) ৪০ বার পাঠ করিলে ৪০ বৎসরের ছগীরা গুনাহ মাফ হইয়া যাইবে।

দুই দুই রাকাত করিয়া চার রাকাত নামায পড়িবে সূরা ফাতিহার পর প্রত্যেক রাকাতেই সূরা ইখলাস দশবার করিয়া পাঠ করিবে ও এই নিয়মেই নামাজ শেষ করবে। হাদীস শরীফে আছে,- যাহারা এই নামায পড়িবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাহাদের চারটি হাজত পুরা করিয়া দিবেন ও তাহাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন। তৎপর ঐ রাত্রিতে দুই দুই রাকাত করিয়া আরও চার রাকাত নফল নামাজ পড়িবে। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ক্বদর একবার ও সূরা এখলাছ পঁচিশ বার পাঠ করিবে এবং এই নিয়মে নামাজ শেষ করবে।হাদীস শরীফে আছে, মাতৃগর্ভ হইতে লােক যেরূপ নিস্পাপ হইয়া ভূমিষ্ট হয়, উল্লেখিত ৪ রাকাত নামাজ পড়িলেও সেইরূপ নিস্পাপ হইয়া যাইবে। (মিশকাত)

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

হাদীস শরীফে আছে, যাহারা এই নামাজ পাঠ করিবে, আল্লাহ তায়ালা তাহাদের পঞ্চাশ বৎসরের গুনাহ মার্জনা করিয়ে দিবেন। (তিরমিজী)। আরও হাদীসে আছে,- যাহারা উক্ত রাত্রে বা দিনে ১০০ হইতে ৩০০ মরতবা দরুদ শরীফ হযরত সঃ এর উপর পাঠ করিবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাদের উপর দোযখ হারাম করিবেন। হযরত সঃ ও সুপারিশ করিয়া তাহাদিগকে বেহেশতে লইবেন। (সহীহ বুখারী)

আর যাহারা উক্ত রাত্রিতে সূরা দুখান সাতবার ও সূরা ইয়াসীন তিনবার পাঠ করিবে, আল্লাহ তাহাদের তিনটি মকসুদ পুরা করিবেন। যথাঃ (১) হায়াত বৃদ্ধি করিবেন। (২) রুজি-রিজিক বৃদ্ধি করবেন। (৩) সমস্ত পাপ মার্জনা করিবেন।

উপরের কথাগুলি বানােয়াট ও ভিত্তিহীন। সবচেয়ে দুঃখজনক কথা হলাে, গ্রন্থকার এখানে মিশকাত, তিরমিযী ও বুখারীর উদ্ধৃতি দিয়েছেন ভিত্তিহীন কিছু কথার জন্য, যে কথাগুলো এ গ্রন্থ গুলি তো দূরের কথা কোন হাদীসের গ্রন্থেই নেই। এভাবে প্রতারিত হচ্ছেন সরলপ্রাণ বাঙালি পাঠক। বস্তুত এই জাতীয় প্রচলিত পুস্তকগুলি জাল ও মিথ্যা কথায় ভরা। মহান আল্লাহ এ সকল লেখকের নেক নিয়্যাত ও খেদমত কবুল করুন এবং আমাদেরকে ও তাদেরকে ক্ষমা করুন। 

সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতামত ও কর্ম

পূর্বে আলোচিত হাদীসগুলো মারফু বা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর নামে বর্ণিত ও প্রচারিত হাদীস। আমরা দেখেছি যে, সেগুলির মধ্যে কিছু হাদীস নির্ভরযোগ্য বা সহীহ ও হাসান, যেগুলো রাসূলুল্লাহ -এর বাণী বা কর্ম বলে প্রমাণিত। বাকী হাদিস গুলো অত্যন্ত দুর্বল বা বানোয়াট। মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ হাদিসগুলো রাসূলুল্লাহ সঃ এর বাণী বা কর্ম নয়। ৩য়/৪র্থ হিজরী শতকে বা পরবর্তীকালে কতিপয় মিথ্যাবাদী রাবী বানোয়াট সনদ তৈরি করে এ সকল কথা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর নামে চালানোর চেষ্টা করেছে। যদিও মুহাদ্দিসগণ সহজেই তাদের জালিয়াতি ধরে ফেলেছেন, কিন্তু অনেক সাধারণ মুসলিম বা কোন কোন ফকীহ ও মুফাসসির তাদের জালিয়াতি দ্বারা ধোকা গ্রস্থ হয়েছেন।

সাহাবী ও তাবেয়ী গণের মতামত ও কর্মকেও মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাদীস বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (স) এর নামে প্রচারিত হাদীসকে হাদীসে মারফু সাহাবীর মতামত বা কর্ম হিসেবে বর্ণিত হাদীসকে হাদীস মাওকুফ ও তাবিয়ীর মতামত ও কর্ম হিসেবে বর্ণিত হাদীসকে হাদীস মাকতু বলে অভিহিত করা হয়। মাওকুফ ও মাকতু উভয় প্রকারের হাদীসকে আসার বলা হয়। এখানে আমরা শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত মাওকুফ ও মাকতু হাদীস গুলি আলোচনা করব।

উল্লেখ্য যে, মধ্য শাবানের রাতের ফযীলত সম্মন্ধে সাহাবাগণ থেকে যয়ীফ সনদে কতিপয় হাদীস বা আসার বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু উক্ত রাতে একাকী বা সম্মিলিতভাবে কোন ইবাদত পালনের ব্যাপারে তাঁদের থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। হাদীস ও আসারের আলোকে সুস্পষ্ট যে, কোনো সাহাবী ব্যক্তিগতভাবে বা সামষ্টিকভাবে কখনােই এ রাত্রিতে কোন বিশেষ ইবাদত করেন নি। সাহাবীগণের যুগে এ রাতটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক কোন ভাবেই উদযাপিত বা পালিত হয় নি।

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

পরবর্তী প্রজন্ম তাবেয়ীগণের যুগ থেকে এ রাতে ইবাদত বন্দেগি করার বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে তাবেয়ীগণ থেকে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়। সিরিয়া বাসী কতিপয় তাবেয়ী এ রাতে বিশেষভাবে ইবাদতে মশগুল থাকতেন। এদের মধ্যে ছিলেন, প্রখ্যাত তাবেয়ী আবু আবদুল্লাহ মাকহুল (১১২ হি), প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ফকীহ খালিদ ইবনে মাদান, আবু আবদুল্লাহ হিমসী (১০৩ হি) ও তাবেয়ী লুকমান ইবনে আমির। কথিত আছে যে, ইহুদিদের মধ্যে প্রচলিত কতিপয় ইসরাইলি রেওয়ায়েত এর উপর ভিত্তি করে তারা এরূপ করতেন। তাদের এ কর্ম যখন প্রচার লাভ করে তখন অন্যান্য আলিম ও সাধারণ লোকদের মধ্যে একদল তাদের সাথে একমত পোষণ করেন এবং অন্যদল আপত্তি করেন।

হিজায বা মক্কা ও মদীনার অধিকাংশ আলেম এ রাত্রিতে বিশেষ কোন ইবাদত পালনের ঘোর আপত্তি করতেন। এদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত ফকীহ ও আবিদ তাবেয়ী আতা ইবনে আবি রাবাহ কুরাশী (১১৪ হি), সুপ্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুহাদ্দিস, ফকীহ ও আবিদ আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইদুল্লাহ ইবনে আবি মুলাইকা আল-মাদানী (১১৭ হি)। এ বিষয়ে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মাওকুফ ও মাকতু হাদীস বা আছার গুলি আলোচনা করা হল।

শবে বরাতের আছার সমূহ

আছার নং ১: 

সাহাবী ইকরিমা রাঃ

ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, মধ্য-শাবানের রাত্রিতে ভাগ্য লিখন বিষয়ক একটি বক্তব্য ইকরিমা থেকে বর্ণিত হয়েছে। এ বক্তব্যটি কোন কোন রাবী ইবনে আব্বাস (রা) এর বক্তব্য বলে উল্লেখ করেছেন। আমরা সনদ পর্যালোচনা করে দেখেছি যে, বক্তব্যটি ইবনে আব্বাসের বক্তব্য নয়, বরং ইকরিমার বক্তব্য।

আছার নং ২: 

তাবেয়ী আতা ইবনে আবি রাবাহ

মধ্য শাবানের রাতে হায়াত-মউত লিপিবদ্ধ করা হয়। এমনকি কোন ব্যক্তি ভ্রমণে বের হয় আর তাকে জীবিতদের তালিকা থেকে মৃতদের তালিকায় স্থানান্তর করা হয়। এবং কোন ব্যক্তি বিবাহ অনুষ্ঠানে থাকে আর তাকে জীবিতদের তালিকা থেকে মৃতদের তালিকায় স্থানান্তরিত করা হয়।

বিশিষ্ট তাবেয়ী আতা ইবনে আবি রাবাহ ইয়াসার (১০৩ হি) এর উক্তি হিসেবে দুর্বল সনদে এ আসরটি বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আবদুর রাজ্জাক সানয়ানী ইবনে উয়াইনা থেকে, তিনি মিস’আর থেকে, তিনি এক ব্যক্তি থেকে, তিনি আতা থেকে বক্তব্যটি বর্ণনা করেন।

আমরা দেখছি যে, আতা থেকে যিনি বক্তব্যটি বর্ণনা করেছেন তিনি অজ্ঞাত পরিচয়। এজন্য আসারটি দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য।

আছার নং ৩: 

তাবেয়ী উমার ইবন আব্দুল আযীয

চার রাতের ব্যাপারে তুমি যত্নবান হও। আল্লাহ তায়ালা ঐ রাতগুলোতে তার রহমত বর্ষণ করেন। রজব মাসের প্রথম রাত, মধ্য শাবানের রাত, ঈদুল ফিতরের রাত ও ঈদুল আজহার রাত।

বর্ণিত আছে যে, এ বাক্যটি বিশিষ্ট তাবেয়ী উমর বিন আব্দুল আযীয (১০২ হি) তার নিয়োজিত একজন গভর্নর তাবেয়ী আদি ইবনে আরতার (১০২ হি) নিকট লিখে পাঠান। আল্লামা হাফিয ইবনে রাজাব (৭৫০ হি) আসারটি উল্লেখ করে বলেন, এর সনদের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আপত্তি আছে।

আছার নং ৪: 

তাবেয়ী খালিদ ইবনে মাদান

বছরের মধ্যে পাঁচটি রাত আছে, যে ব্যক্তি পূণ্য লাভের আশায় এবং এ রাতগুলির ক্ষেত্রে প্রদত্ত ওয়াদাকে সত্য মনে করে নিয়মিতভাবে ঐ পাঁচ রাতে ইবাদত করবে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। রজব মাসের প্রথম রাত, ঈদুল ফিতরের রাত, ঈদুল আজহার রাত, আশুরার রাত ও মধ্য-শাবানের রাত।

এই বক্তব্যটি বিশিষ্ট তাবেয়ী খালিদ বিন মাদান থেকে বর্ণিত হয়েছে। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সিরিয়ার যে সকল তাবেয়ী এ রাতটি ইবাদতে কাটাতেন তাদের অন্যতম ছিলেন খালিদ ইবনে মাদান।

আছার নং ৫: 

তাবেয়ী ইবনে আবী মুলাইকা

ইমাম আব্দুর রাজ্জাক সানআনী তার উস্তাদ মামার ইবনে রশিদ থেকে, তিনি আইয়ুব থেকে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন, বিশিষ্ট তাবেয়ী ইবনে আবি মুলায়কার কাছে বলা হলো যে, যিয়াদ নুমায়রী -তিনি একজন গল্পকার ওয়ায়েজ ছিলেন- তিনি বলেন, মধ্য শাবানের রাতের ফজিলত লাইলাতুল কদরের ফযীলতের সমান; তখন ইবনে আবি মুলাইকা বলেন, আমি যদি তাকে এ কথা বলতে শুনতাম আর আমার হাতে লাঠি থাকত আমি তাকে প্রহার করতাম।

তাবেয়ী ইবনে আবী মুলাইকার বক্তব্যটির সনদ অত্যন্ত সহীহ; সনদটি ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ। কারণ সনদের রাবী আব্দুর রাজ্জাক বিন হাম্মাদ আল-হিমইয়ারী (২১১ হি) বিশ্বস্ত ও হাদীসের অন্যতম ইমাম; তার শায়খ মামার বিন রাশেদ আল-আযদী (১৫৪ হি) বিশ্বস্ত ও হাদীসের ইমাম; তার শায়খ আইয়ুব ইবনে আবি তামিমা কাইসান আল- সিখতিয়ানী (মৃত্যু-১৩১হি) বিশিষ্ট ফক্বীহ, আবিদ ও বিশ্বস্ত রাবী। বক্তব্য দাতা আব্দুল্লাহ বিন উবায়দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন আবি মুলাইকা আত-তায়মী আল-মাদানী (১১৩ হি) বিশিষ্ট তাবেয়ী যিনি ৩০ জনেরও বেশি সাহাবী থেকে হাদীস শিক্ষা করেছেন এবং হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ছিলেন।

এদের সকলের হাদীস ইমাম বুখারী ও মুসলিম গ্রহণ করেছেন; এভাবে আমরা দেখছি যে, ইবনে আবী মুলাইকার বক্তব্যটি বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত; এ বর্ণনায় যিয়াদ নুমাইরী নামক যে ব্যক্তি মধ্য শাবানের ফজিলত লাইলাতুল কদরের ফযীলতের সমান বলে দাবি করেছেন তিনি হচ্ছেন যিয়াদ বিন আব্দুল্লাহ নুমায়রী; তিনিও একজন তাবেয়ী; তিনি ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও নেককার লোক ছিলেন; কিন্তু হাদীস সংরক্ষণ ও বর্ণনার ক্ষেত্রে ছিলেন দুর্বল; হাদীস বর্ণনায় তিনি অনেক ভুল করতেন।

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

আর এ কারণে ইয়াহইয়া বিন মাইন তাকে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন; আবু হাতিম রাযী বলেছেন, যিয়াদ নুমায়রীর হাদীস নিরীক্ষার জন্য লেখা যাবে, তবে তা দলিল হিসাবে গ্রহণযােগ্য নয়; ইবনু হিব্বান তার বিষয়ে বলেন, তিনি ভুল করতেন এবং আবিদ ছিলেন; অন্যত্র তিনি বলেন, তার বর্ণিত হাদীস অগ্রহণযোগ্য ও পরিত্যাজ্য; তার বর্ণনা দলীল হিসেবে গ্রহণ করা যায় না; ইবনু হিব্বান আরো বলেছেন, ইয়াহইয়া বিন মাঈন তাকে (যিয়াদকে) পরিত্যাগ করেছেন এবং বলেছেন, সে কিছুই না; এমনিভাবে ইমাম আবু দাউদ, ইমাম তিরমিযী ও অন্যন্য ইমাম তাকে দুর্বল হিসেবে অভিহিত করেছেন; ইবনু আদি বলেছেন, যিয়াদের কাছ থেকে কোন বিশ্বস্ত রাবী হাদীস বর্ণনা করলে সমস্যা নেই; ইবনে হাজার আসকালানী বলেছেন, যিয়াদ ইবনে আব্দুল্লাহ নুমাইরী দুর্বল।

উল্লিখিত আসার থেকে আমাদের কাছে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে; প্রথমত, মধ্য শাবানের রাতের মর্যাদা নিয়ে অতিরঞ্জিত বক্তব্য হিজরী দ্বিতীয় শতকে তাবেয়ীদের যুগে কতিপয় গল্পকার ওয়ায়েজদের পক্ষ থেকে প্রচারিত হয়েছে; যেমনটি আমরা উক্ত যিয়াদের বক্তব্যে লক্ষ্য করেছি; তিনি মধ্য শাবানের রাত ও কদরের রাতকে সমমর্যাদা সম্পন্ন হিসেবে দাবি করেছেন; তবে তিনি তার এই দাবিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বা সাহাবীর মত বা বক্তব্য বলে দাবি করেন নি, বরং তার নিজের মত বলেই প্রচার করেছেন; দ্বিতীয়ত, অনেক প্রবীণ তাবেয়ী মুহাদ্দিস ও ফকীহ তাদের এ বাড়াবাড়িকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

আছার নং ৬: 

মদিনার তাবেয়ীগণের মতামত

তাবি-তাবিয়ী আব্দুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম (১৮২ হি) বলেন,

আমি আমাদের (মদিনার) ফকীহগণকে এবং আমাদের উস্তাদ মাশাইখগণকে দেখেছি যে, তাদের মধ্যে কেউই মধ্য শাবানের রাতের প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করতেন না; তাদের কাউকেই আমরা মাকহুলের হাদীস বর্ণনা করতে শুনিনি; তারা কেউই বছরের অন্য সাধারণ রাতগুলোর উপরে এই রাতের কোন বিশেষ ফযীলত বা মর্যাদা আছে বলে মনে করতেন না; তিনি বলেন (মদীনার) ফকীহগণ এ রাত্রির ইবাদত বন্দেগি কিছুই করতেন না।

মুহাম্মদ বিন ওয়াদ্দা আল কুরতুবী (২৮৬ হি) হারুন বিন সাঈদ থেকে, তিনি ইবনে ওয়াহাব থেকে, তিনি আব্দুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি এ কথাটি বলেন।

তাবি-তাবিয়ী আব্দুর রহমান বিন যায়েদ- এর এই বক্তব্যটির সনদ তার পর্যন্ত বিশুদ্ধ; সনদের রাবী হারুন বিন সাঈদ (২৫৩ হি) বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী; তার শায়খ আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব ইবনে মুসলিম আল-কুরাশী (১৯৭ হি) ফিকহ ও হাদীসের ইমাম ছিলেন এবং অত্যন্ত বিশ্বস্ত রারী ও আবেদ ছিলেন।

বক্তব্যদাতা হচ্ছেন উমর (রা) -এর গোলাম আসলামের পৌত্র আব্দুর রহমান ইবনুল যাইদ ইবনে আসলাম (১৮২ হি); তিনি মদীনার একজন বিশিষ্ট আলেম ও তাবে তাবেয়ী; তিনি মদীনার অনেক তাবেয়ী ও আলেমের কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন; তবে তিনি হাদীস মুখস্ত, সংরক্ষণ ও বর্ণনার ক্ষেত্রে দুর্বল ছিলেন।

এ আছারগুলি থেকে বুঝা যায় যে, তাবেয়ীদের যুগে মধ্য শাবানের রাতের বিশেষ ইবাদত প্রসিদ্ধি লাভ করেনি; পূর্বেই দেখেছি যে, সিরিয়ার তাবিয়ী মাকহুল উক্ত রাতের ফযীলত সংক্রান্ত অধিকাংশ হাদীস বর্ণনা করেছেন; এই হাদিস গুলো এবং এই রাতে ইবাদত করার প্রচলন এই সময়ে প্রচার ও প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। 

চার ইমাম ও অন্যান্য ফকীহদের মতামত

আব্দুর রহমান বিন যায়েদ-এর বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি যে, মদিনার তাবেয়ী আলেমগণ শবে বরাতের আমলের প্রতি কোনরূপ ভ্রূক্ষেপ করতেন না; পরবর্তী যুগের ফকীহ ও আলিমগণ উক্ত রাতের মর্যাদা নিয়ে মতভেদ করেছেন; মদীনার আলেম কুল শিরোমণি ইমাম মালিক (১৭৯ হি) ও তার অনুসারী ফকীহ ও ইমামগণ উক্ত রাতের বিশেষ ইবাদত পালন করতে নিষেধ করেছেন; তারা বলেন, এ রাতের গুরুত্ব দেওয়া, এ রাত্রিতে বিশেষ ইবাদত পালন করা বা এ রাত্রি উদযাপন করা বিদআত ও নিষিদ্ধ।

পক্ষান্তরে তৎকালীন যুগের সিরিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে আমর আল-আউযায়ী (১৫৭ হি) মনে করতেন যে, এ রাত্রিতে ব্যক্তিগতভাবে একাকী নিজ গৃহের মধ্যে ইবাদত ও দোয়া মুনাজাতে রত থাকা মুস্তাহাব; ইমাম শাফেয়ীও (২০৪ হি) অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন; সিরিয়ার কোন কোন ফকীহ এ রাত্রে মসজিদে এসে ইবাদত বন্দেগি করাকে ভাল বলে মনে করতেন; ইমাম আবু হানিফা (১৫০ হি) ও ইমাম আহমদ (২৪১ হি) এ বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট মত ব্যক্ত করেননি।

পরবর্তী যুগের প্রসিদ্ধ হাম্বলী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবনে রাজাব (৭৫০ হি) ও অন্যান্য অনেক হাম্বলী ও হানাফী ফকীহ ইমাম আওযায়ী ও শাফেয়ীর মতের সমর্থন করেছেন; তারা ব্যক্তিগতভাবে এ রাত্রিতে কিছু দোয়া-মোনাজাত ও ইবাদত করাকে ভাল মনে করতেন; তবে তারা এ রাত্রিতে ইবাদত করার জন্য সমবেত হওয়া বা আনুষ্ঠানিকভাবে রাত্রিটি পালন করাকে অপছন্দ করতেন ও মাকরূহ বলে উল্লেখ করেছেন।

প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা হাসান ইবনে আম্মার শুরুবুলালী (১০৬৯ হি) উল্লেখ করেছেন যে, দু ঈদের রাত্রি, যিলহজ্জ মাসের দশ রাত্রি ও মধ্য-শাবানের রাত্রি ইবাদত বন্দেগিতে কাটানাে মুস্তাহাব, তবে এজন্য মসজিদে বা অন্য কোথাও সমবেত হওয়া মাকরূহ; তিনি বলেন: এ সকল রাত্রি ইবাদতে কাটাতে মসজিদে বা অন্য কোথাও সমবেত হওয়া মাকরূহ; কারণ রাসূলুল্লাহ সাঃ এরূপ করেন নি, এবং তাঁর সাহাবীগণও এরূপ করেন নি; প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা ইবনে নুজাইম (৯৭০ হি), আল্লামা আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ তাহতাবী (১২৩১ হি) প্রমুখ একই কথা বলেছেন।

শবে বরাতের হাদিস গুলোর প্রতিপাদ্য

মধ্য শাবানের ফযীলত, মর্যাদা ও ইবাদত বন্দেগি সম্পর্কে বর্ণিত ও বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত সহীহ, যয়ীফ ও মওজু হাদিস গুলো আমরা পূর্বে আলােচনা করলাম; হাদীস বিষয়ক গ্রন্থসমূহে এ বিষয়ে আর কোনো মূল হাদীস সংকলিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই; তবে একেবারে সনদ হীনভাবে আরো অনেক কথাই বিভিন্ন ওয়ায, গল্প বা ফযীলতের গ্রন্থে পাওয়া যায়, যেগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন এবং সনদ না থাকার কারণে হাদীসতাত্ত্বিক ভাবে সেগুলোর বিচারও সম্ভব নয়।

এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, সহীহ হাদীসের জন্য গ্রন্থ, সনদ বা রেফারেন্স প্রয়োজন হয়; জাল বা বানোয়াট হাদীসের জন্য গ্রন্থ ও রেফারেন্সের প্রয়ােজন হয় না; অনেক সময় আমরা দেখি যে, কোনাে প্রচলিত পত্র পত্রিকায়, বইয়ে বা বক্তব্যে কোনোরূপ সনদ, গ্রন্থ বা সূত্র উল্লেখ না করেই ‘হাদীসে আছে’ বা ‘হাদীস শরীফে বলা হয়েছে বা অনুরূপ শিরোনামে অনেক কথা বলা হয় যা কোন হাদীসের গ্রন্থে পাওয়া যায় না; বস্তুত অতীত যুগে জালিয়াতগণকে জাল হাদীস বানানোর জন্য বানোয়াট সনদ তৈরি করতে হতো; কিন্তু বর্তমানে হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন বা অনুরূপ কিছু বললেই সকলেই মেনে নেয়; এরূপ একেবারে সনদবিহীন ভিত্তিহীন কথাবার্তা বাদ দিয়ে মধ্য শাবানের রজনী সম্পর্কিত প্রচলিত ও বর্ণিত হাদীস গুলো আমরা আলােচনা করলাম; এ আলোচনার ভিত্তিতে আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি তা হলো:

১. সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, এ রাত্রিতে আল্লাহ মুশরিক ও বিদ্বেষে লিপ্ত মানুষ ছাড়া অন্যদেরকে ক্ষমা করেন। কিন্তু এ রাত্রিতে বিশেষ কোন আমল করতে হবে বা এ রাত্রির ক্ষমা লাভের জন্য বান্দাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে বলে কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়নি।

২. এ রাত্রিতে ভাগ্য লিখা হয় মর্মে রাসূলুল্লাহ সা ও সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট, মিথ্যা বা দুর্বল। 

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

৩. এ রাত্রিতে কবর যিয়ারত করা, মৃতদের জন্য ক্ষমা চাওয়া, নিজের পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ ও মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা এবং সালাত আদায় করার উৎসাহ প্রদান করে কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সমস্ত হাদীসগুলির সনদেই দুর্বলতা আছে এবং সাহাবীগণ এসব আমল করেছেন এমনটি জানা যায় না। তাই এগুলি থেকে বিরত থাকাই উত্তম।

৪. এ সকল ইবাদত দলবদ্ধভাবে আদায় করা, সে জন্য মসজিদে বা অন্য কোথাও সমবেত হওয়া, উক্ত রাতে বিশেষ ভাবে গোসল করা, নির্দিষ্ট সূরা পাঠের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করে নামায আদায় করা, হালুয়া-রুটি তৈরি ও বিতরণ করা, বাড়ি, গোরস্থান বা কবরে আলোকসজ্জা করা ইত্যাদি কর্ম একেবারেই ভিত্তিহীন, সুন্নাত বিরোধী এবং নব-উদ্ভাবিত কর্ম অর্থাৎ বিদআত, যা একেবারেই ভ্রষ্টতা।

৫. ১৫ই শাবানের দিবসে সিয়াম পালনের ফযীলতে কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয়নি; তবে শাবান মাসে বেশি বেশি সিয়াম পালন, বিশেষত প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত সিয়াম পালন রাসূলুল্লাহ সাঃ এর সুপরিচিত সুন্নাত; এ ছাড়া প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে সিয়াম পালনও সুন্নাত নির্দেশিত গুরুত্বপূর্ণ মুসতাহাব ইবাদত; এজন্য সম্ভব হলে শাবানের প্রথম ১৫ দিন, না হলে অন্তত ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে সিয়াম পালন উচিত। 

৬. সূরা দুখানে উল্লিখিত মুবারাক রজনী বলতে শবে বরাত বুঝানো হয় নি, বরং শবে কদর বুঝানো হয়েছে; কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সমন্বিত অর্থ ও সাহাবী-তাবেয়ী গণের ব্যাখ্যার আলোকে এ কথা নিশ্চিত যে, মোবারক রজনী বলতে লাইলাতুল ক্বদর বুঝানো হয়েছে; কাজেই সূরা দুখান এর আয়াতগুলো মধ্য-শাবানের রজনীর জন্য প্রযোজ্য নয়; তবে মধ্য শাবানের রজনীর পৃথক মর্যাদা রয়েছে আর তা হচ্ছে এই রাতটি বিশেষ ক্ষমার রাত।

মুমিন জীবনের প্রতিটি রাতই শবে বরাত

সবচেয়ে বড় কথা হলাে, মুমিন যদি একটু আগ্রহী হন তবে প্রতি রাতই তার জন্য শবে বরাত। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য ইমাম সংকলিত সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সঃ বলেন:

প্রতি রাতে রাতের প্রথম তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হলে আল্লাহ প্রথম আসমানে নেমে বলেন, আমিই রাজাধিরাজ, আমিই রাজাধিরাজ; আমাকে ডাকার কেউ আছ কি? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। আমার কাছে চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে প্রদান করব। আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছে কি? তাকে আমি ক্ষমা করব। প্রভাতের উন্মেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবে তিনি বলতে থাকেন।

অন্যান্য হাদীসে বলা হয়েছে যে, মধ্যরাতের পরে এবং বিশেষত রাতের দুই-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পর তওবা কবুল, দুআ কবুল ও হাজত মেটানোর জন্য আল্লাহ বিশেষ সুযোগ দেন।

তাহলে আমরা দেখছি, লাইলাতুল বারাআতের যে ফযিলত ও সুযােগ, তা মূলত প্রতি রাতেই মহান আল্লাহ সকল মুমিনকে প্রদান করেন; লাইলাতুল বারাআত বিষয়ক জয়ীফ হাদিস গুলো থেকে বোঝা যায় যে, এ সুযোগ শবে বরাতের সন্ধ্যা থেকে; আর উপরের সহীহ হাদীসগুলি থেকে জানা যায় যে, প্রতি রাতেই এ সুযোগ শুরু হয় রাতের এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩/৪ ঘন্টা রাত অতিবাহিত হওয়ার পরে, রাত ১০/১১ টা থেকে; কাজেই মুমিনের উচিত শবে বরাতের আবেগ নিয়ে প্রতি রাতেই সম্ভব হলে শেষ রাত্রে, না হলে ঘুমানোর আগে রাত ১০/১১ টার দিকে দুই চার রাকআত সালাত আদায় করে মহান আল্লাহর দরবারে নিজের সকল কষ্ট, হাজত, প্রয়ােজন ও অসুবিধা জানিয়ে দুআ করা, নিজের যা কিছু প্রয়োজন আল্লাহর কাছে চাওয়া এবং সকল পাপ-অন্যায় থেকে ক্ষমা চাওয়া।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বিষয়গুলি সঠিকভাবে বুঝার ও মেনে চলার তাওফীক দান করুক। আল্লাহুম্মা আমীন।

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম, শবে বরাতের ফজিলত, শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস, শবে বরাতের নামাজ কত রাকাত, শবে বরাতের নামাজের নিয়ত, শবে বরাতের আমল, শবে বরাত নামাজের নিয়ত, শবে বরাতের রোজা কয়টি, শবে বরাতের নামাজ, লাইলাতুল বরাত, শবে বরাতের নিয়ত, শবে বরাতের দোয়া, শবে বরাতের ইতিহাস, শবে বরাত কি বিদআত, শবে বরাতের নামাজ পড়ার নিয়ম, শবে বরাত নামাজের নিয়ম, শবে বরাতের রোজা, শবে বরাতের রোজার নিয়ত, শবে বরাত কি, শবে বরাতের নামাজের নিয়ত, শবে বরাতের নামাজের নিয়ত আরবি, শব ই বরাত, শবে বরাত এর ফজিলত, লাইলাতুল বরাত নামাজের নিয়ত, শবে বরাতের নামাজের দোয়া

মহিলাদের শবে বরাতের নামাজের নিয়ম, সবে বরাত, শবে বরাতের নামাজ কয় রাকাত, শবে বরাতের হাদিস, শবে বরাত সম্পর্কে কোরআনের আয়াত, শবে বরাত অর্থ কি, লাইলাতুল বরাতের নামাজের নিয়ত, শবে বরাত এর আমল, শবে বরাতের নামাজের নিয়ম, শবে বরাতের নামাজের নিয়ত ও দোয়া, শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস, শবে বরাত নামাজ, শবে বরাতের রোজার ফজিলত, শবে বরাত নামাজ কত রাকাত, শবে বরাতের আমল ও ফজিলত, শবে বরাত নামাজের নিয়ত, শবে বরাতের নামাজের নিয়ম ও দোয়া, শবে বরাতের দোয়া সমূহ, শবে বরাতের দোয়া

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

shab e barat namaz, shab e barat namaz niyat, shabe barat, lailatul barat, shab e barat dua, what is shab e barat, shabe barat namaz, shab e barat namaz niyom, shab e barat namaz koto rakat, shab e barat namaz niyat bangla, shab e barat er amol, sobe borat er namaz koto rakat, sobe borat namajer niyom

শবে বরাত

শবে বরাত ২০২৪ কত তারিখে? Shab e Barat 2024 date in Bangladesh