শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম, শবে বরাতের ফজিলত, শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস, শবে বরাতের আমল, শবে বরাতের রোজা কয়টি, shab e barat namaz

শবে-বরাতের-নামাজের-নিয়ম.-শবে-বরাতের-ফজিলত-ও-আমল-সম্পর্কে-হাদিস

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, কুরআন ও হাদিসের আলোকে শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

Table of Content

  1. শবে বরাত অর্থ কি
  2. শবে বরাত সম্পর্কে কোরআনের আয়াত
  3. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস
  4. শবে বরাতে বিশেষ ক্ষমা
  5. শবে বরাতে ভাগ্য নির্ধারণ
  6. শবে বরাতের দোয়া
  7. শবে বরাতে কবর জিয়ারত
  8. শবে বরাতের নামাজের নিয়ম কানুন
  9. শবে বরাতের রোজা কয়টি
  10. কিছু সনদ বিহীন বানোয়াট কথা
  11. প্রচলিত আরো কিছু ভিত্তিহীন কথা
  12. সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতামত ও কর্ম
  13. চার ইমাম ও অন্যান্য ফকীহদের মতামত
  14. শবে বরাতের হাদিস গুলোর প্রতিপাদ্য
  15. মুমিন জীবনের প্রতিটি রাতই শবে বরাত

শবে বরাত অর্থ কি

ফার্সী ভাষায় শব শব্দটির অর্থ রাত বা রজনী আর বরাত শব্দটির অর্থ ভাগ্য; তাই শবে বরাত শব্দের অর্থ হলো ভাগ্য রজনী; আরবীতে একে লাইলাতুল বারাআত বলা হয়; লাইলাতুল অর্থ রাত বা রজনী আর বারাআত শব্দটির অর্থ বিমুক্তি, সম্পর্কচ্ছিন্নতা, মুক্ত হওয়া, নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ইত্যাদি; ফার্সী শবে বরাত বা ভাগ্য রজনী আরবী লাইলাতুল বারাআত বা বিমুক্তির রজনী বলতে আরবী বছরের ৮ম মাস অর্থাৎ শাবান মাসের মধ্যম রজনীকে বুঝানাে হয়।

কুরআন ও হাদীসে কোথাও লাইলাতুল বারাআত পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়নি; সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগেও এ পরিভাষাটির ব্যবহার জানা যায় না; এ রাতটিকে হাদীস শরীফে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা মধ্য-শাবানের রজনী বলা হয়েছে; সাহাবী তাবেয়ী গণের যুগের অনেক পরে এ রাতটিকে লাইলাতুল বারাআত বা বিমুক্তির রজনী বলে আখ্যায়িত করার প্রচলন দেখা দেয়।

এ রাতটিকে ফার্সী ভাষায় শবে বরাত বাংলা ভাষায় ভাগ্য রজনী বলা হলেও কুরআন ও হাদিসে কোথাও বলা হয়নি যে এ রাতটি শবে বরাত বা ভাগ্য রজনী; অর্থাৎ এই রাতে ভাগ্য নির্ধারণ করা হয় বলে যে ধারণা মানুষের মধ্যে রয়েছে তা বানোয়াট বা মিথ্যা।

আমরা জানি, পরিভাষার বিষয়টি প্রশস্ত, তবে মুমিনের জন্য সর্বদা কুরআন সুন্নাহ ও সাহাবীগণের ব্যবহৃত পরিভাষা ব্যবহার করাই উত্তম; তাই আমরা এ রাতের জন্য লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান পরিভাষাটি ব্যবহার করব যার বাংলা অর্থ হলো শাবান মাসের মধ্য রজনী।

শবে বরাত সম্পর্কে কোরআনের আয়াত

শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাআত পরিভাষা কুরআন কারীমে কোথাও ব্যবহৃত হয়নি; লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রজনী পরিভাষাটিও কুরআন কারীমে কোথাও ব্যবহৃত হয়নি; তবে কুরআন কারীমের একটি আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ শবে বরাত প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন।

মহান আল্লাহ বলেন: আমি তাে তা অবতীর্ণ করেছি এক মোবারক (বরকতময়) রজনীতে এবং আমি তো সতর্ককারী; এ রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।

মুবারক রজনীর ব্যাখ্যায় বিভিন্ন সাহাবী ও তাবিয়ী বলেছেন যে, এ রাতটি হলাে লাইলাতুল ক্বদর বা মহিমান্বিত রজনী; সাহাবীগণের মধ্য থেকে ইবনু আব্বাস (রা) ও ইবনু উমার (রা) থেকে অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে; তাবেয়ীগণের মধ্য থেকে আবু আব্দুর রহমান আল-সুলামী (৭৪ হি), মুজাহিদ বিন জাবুর (১০২ হি), হাসান বসরী (১১০ হি), ক্বাতাদা ইবনু দি’আমা (১১৭ হি) ও আব্দুর রহমান বিন যায়েদ বিন আসলাম (১৮২ হি) বিশেষ ভাবে উল্লেখযােগ্য; তারা সকলেই বলেছেন যে, লাইলাতুম মুবারাকাহ অর্থ লাইলাতুল ক্বদর।

এ সকল সাহাবী-তাবিয়ীর মতের বিপরীতে একজন তাবেয়ী মত প্রকাশ করেছেন যে, এ আয়াতে বরকতময় রাত্রি বলতে শবে বরাত বুঝানো হয়েছে। সাহাবী ইবনে আব্বাস (মৃ. ৬৮ হি)-এর খাদেম তাবেয়ী ইকরিমাহ (মৃ. ১০৪ হি) বলেন, এখানে মুবারক রজনী’ বলতে মধ্য শাবানের রাতকে বুঝানো হয়েছে। ইকরিমাহ বলেন, এই রাতে গোটা বছরের সকল বিষয়ের ফয়সালা করা হয়।

অধিকাংশ বর্ণনাকারী এ বক্তব্যটি ইকরিমার বক্তব্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন; দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন বর্ণনাকারী বক্তব্যটি ইবনে আব্বাসের বক্তব্য বলে উল্লেখ করেছেন; আন-নাদর বিন ইসমাঈল (১৮২ হি) নামক এক ব্যক্তি বলেন, তাকে মুহাম্মদ বিন সুক্কা বলেছেন, তাকে ইকরিমাহ বলেছেন ইবনে আব্বাস থেকে, তিনি উপরে উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: মুবারক রজনী হলাে মধ্য-শাবানের রাত; এতে মৃত্যু বরণকারীদের নাম বর্ণনা করা হয়, হাজীদের তালিকা তৈরি হয়, অতঃপর কোনো বাড়তি-কমতি করা হয় না।

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

এ সনদের রাবী আন নাদ ইবনে ইসমাঈল (১৮২ হি) কুফার একজন গল্পকার ওয়ায়েয ছিলেন; তিনি ব্যক্তিগত ভাবে সৎ হলেও হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তার ভুলের কারণে মুহাদ্দিসগণ তাকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন; আবুল হাসান ইজলি বলেছেন, এ ব্যক্তি বিশ্বস্ত; ইয়াহইয়া বিন সাঈদ বলেছেন, সে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ও মূল্যহীন; ইমাম নাসায়ী ও আবু যুর আ বলেছেন, সে শক্তিশালী বা গ্রহণযোগ্য নয়; ইয়াহইয়া বিন মাঈন বলেছেন: নাদর বিন ইসমাঈল সত্যবাদী তবে সে কি বর্ণনা করে তা নিজেই জানে না; ইমাম বুখারী ইমাম আহমদের বরাত দিয়ে বলেন, এ ব্যক্তি সনদ মুখস্থ রাখতে পারত না; ইবনে হিব্বান বলেন, তার ভুল খুব মারাত্মক, যে কারণে তিনি পরিত্যক্ত বলে গণ্য হয়েছেন।

আন-নাদ ইবনে ইসমাইল এর অবস্থা অবলোকন করলে আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি ভুলবশত ইকরিমার বক্তব্যকে ইবনে আব্বাসের বক্তব্য হিসাবে বর্ণনা করেছেন; তিনি সম্ভবত মুহাম্মাদ ইবনু সূকাকে বলতে শুনেছেন ইবনে আব্বাসের মাওলা ইকরিমা থেকে; তিনি ভুলে বলেছেন ইকরিমা থেকে, ইবনু আব্বাস থেকে; এভাবে মাকতু হাদীস বা তাবেয়ীর বক্তব্য মওকুফ বা সাহাবীর বক্তব্যে পরিণত হয়েছে; ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বস্ত অনেক রাবীই স্মৃতির দুর্বলতা, নিয়মিত চর্চা ও পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের অভাবে এভাবে অনেক সময় মাকতু হাদীসকে মওকুফ বা মাওকুফ হাদীসকে মারফু রূপে বর্ণনা করেছেন; অন্যান্য রাবীদের বর্ণনার সাথে তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে মুহাদ্দিসগণ এ সকল ভুল নির্ধারণ করেছেন।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, তাবেয়ী ইকরিমা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি সূরা দুখানে উল্লিখিত মুবারক রজনী বলতে মধ্য শাবানের রজনী বুঝতেন।

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

উল্লেখ্য যে, মুফাসসিরগণ ইকরিমার এ মত গ্রহণ করেন নি; প্রসিদ্ধ মুফাসসিরের মধ্যে কেউই ইকরিমার এ মত গ্রহণ করেন নি; কোন কোন মুফাসসির দুটি মত উল্লেখ করেছেন এবং কোনােটিরই পক্ষে কিছু বলেননি; আর অধিকাংশ মুফাসসির ইকরিমার মতটি বাতিল বলে উল্লেখ করেছেন এবং অন্যান্য সাহাবী-তাবিয়ীর মতটিই সঠিক বলে গ্রহণ করেছেন।

তারা বলেন যে, সঠিক মত হলাে, এখানে মোবারক রজনী বলতে লাইলাতুল কদরকে বুঝানো হয়েছে; মহান আল্লাহ যে রাত্রিতে কুরআন কারীম অবতীর্ণ করেছেন সে রাত্রিকে এক স্থানে লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রজনী’ বলে অভিহিত করেছেন; অন্যত্র এ রাত্রিকেই ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা ‘বরকতময় রজনী’ বলে অভিহিত করেছেন; এবং এ রাত্রিটি নিঃসন্দেহে রামাদান মাসের মধ্যে; কারণ অন্যত্র আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, তিনি রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন; এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুবারক রজনী রামাদান মাসে, শাবান মাসে নয়; তাদের মতে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ এবং লাইলাতুল কদর’ একই রাতের দুটি উপাধি।

এ সকল মুফাসসিরের মধ্যে রয়েছেন মুহাম্মাদ ইবনু জারীর তাবারী (মৃ. ৩১০ হি), আবু জাফর আহমদ ইবন মুহাম্মদ আন-নাহহাস (৩৩৮ হি), আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে উমার আল-যামাখশারী (৫৩৮ হি), ইবনুল আরাবী, আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (৫৩৪ হি), আবু মুহাম্মদ আব্দুল হক ইবনে আতিয়্যা (৫৪৬ হি), আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল-কুরতুবী (৬৭১ হি), আবু হাইয়্যান মুহাম্মদ ইবনু ইউসুফ গারনাতী (৭৫৪ হি), ইসমাঈল ইবনু উমার আবুল ফিদা, ইবনে কাসীর (৭৭৪ হি), আবুস সাউদ মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ আল ইমাদী (৯৫১ হি), মুহাম্মদ ইবনু আলী আল শাওকানী (১২৫০ হি), সাইয়্যেদ মাহমুদ আলুসী (১২৭০ হি), আশরাফ আলী থানভী (১৩৬২ হি), মুহাম্মদ আমীন আল-শানকিতি (১৩৯৩ হি), মুফতী মুহাম্মদ শফী, মুহাম্মদ আলী আল-সাবুনী প্রমুখ।

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু জারীর তাবারী বিভিন্ন সনদে ইকরিমার এ ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করার পরে তার প্রতিবাদ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

সঠিক মত হলাে তাদের মত যারা বলেছেন যে, লাইলাতুম মুবারাকা বা বরকতময় রাত্রি হলাে লাইলাতুল কদর বা মর্যাদার রাত্রি।

অতঃপর তিনি বলেন যে, বরকতময় রাত্রির ব্যাখ্যার ভিত্তিতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফয়সালার বিষয়েও আলিমগণ মতভেদ করেছেন। অনেকে বলেছেন, এ হলাে “লাইলাতুল কদর”, এ রাত্রিতেই পরবর্তী বছরের জন্ম, মৃত্যু, উন্নতি, অবনতি ও অন্যান্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়। হাসান বসরী, কাতাদা, মুজাহিদ, আবু আব্দুর রহমান আস-সুলামী, উমার মাওলা গাফরা, আবূ মালিক, হিলাল ইবনে ইয়াসাফ প্রমুখ তাবেয়ী-তাবি-তাবিয়ী থেকে উদ্ধৃত করেন যে, এদের সকলের মতেই লাইলাতুল কদরে এ সকল বিষয়ের ফয়সালা করা হয়। এরপর তিনি ইকরামা থেকে উদ্ধৃত করেন যে, তার মতে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবানে এ সকল বিষয়ের ফয়সালা করা হয়।

অতঃপর তিনি বলেন: এতদুভয়ের মধ্যে সঠিকতর মত হলাে যারা বলেছেন যে, লাইলাতুল কাদরে এ সকল বিষয়ের ফয়সালা হয়; কারণ আমরা বলেছি যে, এখানে লাইলাতুম মুবারাকা বলতে তো লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে।

এ বিষয়ে আল্লামা আবু বাকর ইবনুল আরাবী (মৃত্যু ৫৪৩ হি) বলেন: অধিকাংশ আলিম বলেছেন যে, লাইলাতুম মুবারাকা বা বরকতময় রজনী হলো লাইলাতুল কদর। কেউ কেউ বলেছেন, তা হলাে মধ্য শাবানের রজনী। এ মতটি বাতিল; কারণ মহান আল্লাহ তার সন্দেহাতীতভাবে সত্য গ্রন্থে বলেছেন: রামাদান মাস যার মধ্যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। এ কথাটি দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানাচ্ছে যে, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় রামাদান মাস। অত জানিয়ে বলা হয়েছে বরকতময় রাত্রিতে। কাজেই কেউ যদি মনে করে যে, এ বরকতময় রাত্রিটি রামাদান ছাড়া অন্য কোনো মাসে তাহলে সে আল্লাহর নামে মহা মিথ্যা বানিয়ে বললাে।

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

আল্লামা কুরতুবী (৬৭১ হি) বলেন: লাইলাতুম মুবারাকা অর্থাৎ বরকতময় রজনী হলো লাইলাতুল কদর। ইকরিমাহ বলেছেন, এখানে বরকতময় রজনী বলতে মধ্য-শাবানের রজনী বুঝানো হয়েছে। প্রথম মতটিই সঠিকতর।

আল্লামা ইবনে কাসীর (৭৭৪ হি) নিশ্চিত করেন যে, বরকতময় রজনী বলতে লাইলাতুল কদরই বোঝানো হয়েছে। অতঃপর তিনি বলেন: ইকরিমাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, বরকতময় রাত্রিটি শাবানের মধ্য রজনী। এই মতটি একটি অসম্ভব ও অবাস্তব মত। কারণ কুরআনে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, এ রাত্রটি রামাদানের মধ্যে।

আশরাফ আলী থানভী (১৩৬২ হি) বলেন: অধিকাংশ তাফসিরকারক লাইলাতুম মুবারাকাকে এখানে শবে কদর বলিয়া তাফসীর করিয়াছেন এবং এ সম্বন্ধে হাদীসও যথেষ্ট রহিয়াছে। আর কেহ কেহ লাইলাতুম মুবারাকা এর তাফসীর করিয়াছেন শবে বরাত। কেননা শবে বরাত সম্মন্ধেও বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, শবে বরাতে বৎসরের যাবতীয় কার্যের মীমাংসা হয়ে থাকে। কিন্তু যেহেতু শবে বরাতে কুরআন নাযিল হয়েছে বলিয়া কোন রেওয়ায়েত নেই এবং শবে কদরে নাজিল হয়েছে বলিয়া স্বয়ং কোরআনের নিশ্চয়ই আমি তা লাইলাতুল কাদরে অবতীর্ণ করেছি আয়াতেই উল্লেখ রহিয়াছে; সেই হেতু শবে বরাত বলিয়া লাইলাতুম মুবারাকা-এর তাফসীর করা শুদ্ধ নহে বলিয়া মনে হয়।

ইকরিমার মতটি প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে মুফাসসিরগণের এরূপ ঐকমত্যের কারণ হলো, ইকরিমার এ মতটি কুরআনের স্পষ্ট বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, আল্লাহ রামাদান মাসে কুরআন নাযিল করেছেন। অন্যত্র বলা হয়েছে যে, একটি মুবারক রাত্রিতে ও একটি মহিমান্বিত রাত্রিতে তিনি কুরআন নাযিল করেছেন। এ সকল আয়াতের সমন্বিত স্পষ্ট অর্থ হলাে, আল্লাহ রমজান মাসের এক রাত্রিতে কুরআন নাযিল করেছেন এবং সে রাত্রটি বরকতময় ও মহিমান্বিত। মোবারক রজনীর ব্যাখ্যায় মধ্য শাবানের রজনীর উল্লেখ করার অর্থ হলো এই আয়াতগুলোর স্পষ্ট অর্থ বিভিন্ন অপব্যাখ্যা ও ঘােরপ্যাচের মাধ্যমে বাতিল করা।

শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

কুরআন কারীমে শবে বরাত বা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান সম্পর্কে কোনোরূপ নির্দেশনা নেই। তবে এ বিষয়ে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। মধ্য শাবানের রজনী বা শবে বরাত সম্পর্কে প্রচলিত হাদিসগুলিকে সেগুলির অর্থ ও নির্দেশনার আলােকে ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

১. শবে বরাতে বিশেষ ক্ষমা সংক্রান্ত হাদীস

২. শবে বরাতে ভাগ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত হাদীস

৩. শবে বরাতের দোয়া সংক্রান্ত হাদিস

৪. শবে বরাতে কবর জিয়ারত সংক্রান্ত হাদীস

৫. শবে বরাতের নামাজ রোজা ও দোয়া সংক্রান্ত হাদীস অনির্ধারিত পদ্ধতিতে

৬. শবে বরাতের নামাজ সংক্রান্ত হাদীস নির্ধারিত পদ্ধতিতে

১. শবে বরাতে বিশেষ ক্ষমা সংক্রান্ত হাদীস

মধ্য শাবানের রজনীর ফযীলতে বর্ণিত প্রথম প্রকারের হাদীস গুলিতে এ রাতের বিশেষ মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ রাতের মর্যাদা ও ফজিলত অর্জনের জন্য বিশেষ কোনাে কর্ম বা আমলের নির্দেশ দেয়া হয়নি। এ অর্থে বর্ণিত হাদীস গুলোর সারমর্ম এই যে, আল্লাহ্ তায়ালা এ রাতে বান্দাদের খোঁজ খবর নেন, তাদের প্রতি দৃকপাত করেন এবং শির্কে লিপ্ত, বিদ্বেষে লিপ্ত, আত্মহননকারী ইত্যাদি কয়েক প্রকারের মানুষ ব্যতীত সকল মানুষের পাপ মার্জনা করে দেন। এ অর্থের হাদীস সমূহ বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে যা সামগ্রিক বিচারে হাদিস বিশারদগণের দৃষ্টিতে বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ অর্থের হাদীস গুলি নিম্নে আলোচনা করা হলো।

হাদীস নং ১: 

আবু মূসা আশআরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,

মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।

এ হাদীসটি ইমাম ইবনু মাজাহ একাধিক সনদে ইবনু লাহীয়ার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের মিশরীয় মুহাদ্দিস ইবনে লাহীয়া (১৭৪ হি) কখনো বলেছেন, তাকে দাহ্হাক ইবনুল আইমান, দাহ্হাক ইবনে আব্দুর রহমান থেকে, তিনি আবু মুসা আশআরী (রা) থেকে হাদীসটি বলেছেন। কখনো তিনি বলেছেন, তাকে যুবাইর ইবনে সুলাইম, দাহ্হাক ইবনে আব্দুর রহমান থেকে, তিনি আবু মূসা (রা) থেকে হাদীসটি বলেছেন।

উক্ত ইবনে লাহীয়া (আব্দুল্লাহ বিন লাহীয়া আল হারামী, আবু আব্দুল্লাহ আল মিসরী) একজন তাবে-তাবেয়ী, বিশিষ্ট আলেম, ফকীহ, ক্বারী ও হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন। কিন্তু হাদীস মুখস্থ করা ও রেওয়ায়েত করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দুর্বল। বিশেষত তার পান্ডুলিপি গুলি পুড়ে যাওয়ার পর। এ কারণেই আল্লামা শিহাবুদ্দীন আহমাদ বিন আবী বা আল বুসিরী (৮৪০ হি) বলেছেন: আব্দুল্লাহ বিন লাহীয়া-এর দুর্বলতার কারণে আবু মূসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসের সনদটি দুর্বল।

হাদীস নং ২: 

আউফ ইবনে মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,

মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন। অতঃপর শিরকে লিপ্ত অথবা বিদ্বেষে লিপ্ত ব্যতীত সকলকে মাফ করে দেন।

এ হাদীসটি আবু বকর আহমদ বিন আমর আল বার তার সনদে ইবনে লাহীয়া থেকে, তিনি তাঁর শায়খ আব্দুর রহমান বিন যিয়াদ বিন আনউম থেকে, তিনি তার সনদে আউফ বিন মালিক (রা) থেকে বর্ণনা করেন।

এই সনদটিও ইবনু লাহীয়া ও তার শায়খ আব্দুর রহমানের দুর্বলতার কারণে দূর্বল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হাফেজ নূরুদ্দীন আলী বিন আবি বকর আল-হায়সামী (৮০৭ হি) বলেন: “এ সনদের মধ্যে আব্দুর রহমান বিন যিয়াদ বিন আনউমকে আহমদ বিন সালেহ নির্ভরযোগ্য বলেছেন, পক্ষান্তরে অধিকাংশ ইমাম তাকে দুর্বল হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর ইবনে লাহীয়াও দুর্বল। এছাড়া সনদের অন্যান্য রাবীগণ নির্ভরযোগ্য।

হাদীস নং ৩: 

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,

আল্লাহ তাআলা মধ্য-শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির দিকে দৃকপাত করেন। অতঃপর বিদ্বেষী ও আত্মহননকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।

এ হাদীসটি ইমাম আহমদ তার সনদে ইবনে লাহীয়া থেকে, তিনি তাঁর শায়খ হুয়াই বিন আব্দুল্লাহ আল মুআফিরী থেকে, তিনি আবু আব্দুর রহমান আল-হাবলী থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবনু লাহীয়ার দুর্বলতার কারণে এ হাদীসের দুর্বলতা স্পষ্ট। আল্লামা হাইসামী বলেন: এ হাদীসের সনদে ইবনে লাহীয়া রয়েছেন। তিনি দুর্বল, এছাড়া বাকি রাবীগণ নির্ভরযোগ্য।

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস নাসির উদ্দিন আলবানী বলেছেন, ইবনে লাহীয়া এককভাবে এ হাদীস বর্ণনা করেননি, বরং রশিদীন বিন সাদ বিন হুয়াই নামক অন্য রাবীও ইবনে লাহীয়ার উস্তাদ হুয়াই বিন আব্দুল্লাহ থেকে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। ফলে হাদীসটি হাদিস বিশারদদের পরিভাষায় হাসান লি গাইরিহী হিসেবে গণ্য হবে।

হাদীস নং ৪:

মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,

মহান আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃকপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষী ব্যতীত সকলকে মাফ করে দেন।

এ হাদীসটি ইবনে আবি আসিম তার সনদে মাকহুল থেকে, তিনি মালেক বিন ইউখামের থেকে, তিনি মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন; আল্লামা হায়সামী বলেন, ইমাম তাবারানী এ হাদীসটিকে তার কাবীর ও আওসাত গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন; উক্ত উভয় বর্ণনার রাবীগণ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য।

এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসটির সনদের রাবীগণ নির্ভরযোগ্য; তবে সনদটি বিশুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হবে যদি মালেক বিন ইউখামের থেকে মাকহুল এর শ্রবণ প্রমাণিত হয়; মাকহুল তাবেয়ী; তিনি ১১২ হি. অথবা তার পরে মৃত্যুবরণ করেছেন; মালেক বিন ইউখামেরও তাবেয়ী; তিনি ৭০ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন; তার মৃত্যুর সময় মাকহুল এর বয়স বিশের কোঠায় ছিল বলে মনে হয়; কাজেই তার সাথে মাকহুল এর সাক্ষাত ও শিক্ষা গ্রহণ অসম্ভব নয়; কিন্তু আল্লামা যাহাবী (৭৪৮ হি) মনে করেন মাকহুল মালেক বিন ইউখামের থেকে শ্রবণ করেননি, বরং তিনি অন্য কারো মাধ্যমে মালিক-এর হাদীস শুনেছেন; বর্ণনার সময় তিনি উক্ত ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করে মুরসাল বা বিচ্ছিন্ন-রূপে মালিক-এর নামে হাদীস বর্ণনা করেছেন; ইমাম যাহাবীর মতানুসারে হাদিসটির সনদ মুনকাতি বা বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল।

হাদীস নং ৫: 

আবু সালাবা আল-খুশানী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,

যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টি জীবের প্রতি দৃকপাত করেন; অতঃপর মুমিনদেরকে মার্জনা করে দেন; আর হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতায় লিপ্তদেরকে তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন।

এ হাদীসটি ইবনে আবি আসিম আহওয়াস বিন হাকিম থেকে তার সনদে আবু সা’লাবা আল-খুশানী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন; আহওয়াস ব্যতীত এ সনদের সকল রাবী বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য; আহওয়াস সম্বন্ধে ইবনে হাজার (৮৫২ হি) বলেন, তিনি তাবেয়ী ছিলেন, আবেদ ছিলেন, তবে তার স্মরণ শক্তি দুর্বল ছিল; এ ধরনের রাবীর বর্ণনা কিছুটা দুর্বল বলে গণ্য হলেও একই অর্থে অন্যান্য রাবীর বর্ণনা থাকলে তা শক্তিশালী বলে গণ্য করা হয়; শাইখ আলবানী এ হাদীসের টীকায় বলেছেন, হাদীসটি সহীহ বা বিশুদ্ধ; এর বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য, শুধুমাত্র আহওয়াস ব্যতীত; তিনি মুখস্ত শক্তিতে দুর্বল; তবে তার মত রাবীর বর্ণনা সমার্থক অন্যান্য রেওয়ায়েত দ্বারা শক্তিশালী বলে গণ্য হবে।

এছাড়া এ হাদীসটি ইমাম তাবরানী ও বায়হাকী তাদের সনদে মাকহুল থেকে, তিনি আবু সালাবা (রা) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেন; ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, মাকহুল তাবেয়ী; সাহাবীদের মধ্য থেকে যাদের মৃত্যু ৭০ হিজরী সনের পরে হয়েছে; তাদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছে; আবু সালাবা (রা) ৪০ হিজরী সনে অথবা তার অল্প কিছু পরে ইন্তেকাল করেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, হাদীসটির সনদ মুনকাতে বা বিচ্ছিন্ন; আবু সা’লাবা (রা) -এর সাথে মাকহুলের সাক্ষাৎ হয়নি; তিনি অন্য কারো মাধ্যমে হাদীসটি শুনেছেন, যার নাম তিনি উল্লেখ করেন নি; এজন্য বায়হাক্বী বলেন, হাদীসটি মাকহুল ও আবু সালাবা -এর মাঝখানে বিচ্ছিন্ন এবং মুরসাল বা বিচ্ছিন্ন রূপে হাদীসটি শক্তিশালী।

হাদীস নং ৬: 

আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ কি বলেছেন:

যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ তাআলা মুশরিক-অংশীবাদী অথবা বিদ্বেষী ব্যতীত সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।

এ হাদীসটি ইমাম বাযযার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হিশাম বিন আব্দুর রহমানের সনদে আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। হিশাম অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি হওয়ার কারণে এ সনদটি দুর্বল। আল্লামা হায়সামী বলেন, এ সনদে হিশাম বিন আব্দুর রহমান সম্বন্ধে কোন কিছু জানা যায়না, তবে সনদের অন্যান্য রাবী নির্ভরযোগ্য।

হাদীস নং ৭: 

আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সঃ বলেছেন:

যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ্ তায়ালা দুনিয়ার আসমানে অবরতণ করেন। অতঃপর তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে শিরকে জড়িত অথবা নিজের ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।

এ হাদীসটি ইমাম বাযযার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস আব্দুল মালিক ইবনে আব্দুল মালেকের সনদে আবু বকর (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। আল্লামা হায়সামী বলেন, এ সনদের আব্দুল মালেক ইবনে আবদুল মালেককে ইবনে আবি হাতিম (রা) তার ‘আল-জারহু ওয়াত তাদীল’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন তবে তার কোনো দুর্বলতা উল্লেখ করেননি। এছাড়া সনদের রাবীগণ নির্ভরযোগ্য। কিন্তু ইমামুল মুহাদ্দিসিন ইমাম বুখারী (রা) উক্ত আব্দুল মালেক ইবনে আব্দুল মালেক এবং তার এ সনদকে দুর্বল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

হাদীস নং ৮: 

আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন:

মহিমান্বিত পরাক্রান্ত আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। অতঃপর কালব সম্প্রদায়ের মেষপালের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন।

হাদীসটি ইমাম তিরমিযী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস দুর্বল সনদে বর্ণনা করেছেন। ১৬ নং হাদীসের আলোচনায় আমরা এর সনদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারব।

হাদীস নং ৯: 

তাবেয়ী কাসীর ইবনে মুররা বলেন, রাসূলুল্লাহ কি বলেছেন:

তোমাদের প্রতিপালক মধ্য শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি দৃকপাত করেন এবং শিরকে লিপ্ত অথবা সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করেন।

এ হাদীসটি হারিস ইবনে উসামা (২৮২ হি) তার মুসনাদে খালিদ ইবনে মাদান থেকে, তিনি কাসীর ইবনে মুররা থেকে মুরসাল হিসেবে বর্ণনা করেন। ইমাম বায়হাক্বীও হাদীসটি তার সনদে মাকহুল থেকে, তিনি কাসীর ইবনে মুররা থেকে বর্ণনা করেন। হাদীসটি উদ্ধৃত করে বাইহাকী বলেন, এটি শক্তিশালী মুরসাল।

উপরের ৯টি হাদীস একই অর্থ নির্দেশ করে। তা হলাে, এ রাতের মর্যাদা। হাদীসগুলোর আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে, এ রাতের মর্যাদা ও এ রাত্রে মহান আল্লাহ কর্তৃক বান্দাদের ক্ষমা করার বিষয়টি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত। শায়খ মুহাম্মদ আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (১৩৫৩ হি) উল্লিখিত হাদিস গুলোর মধ্য থেকে কতিপয় হাদীস উল্লেখ পূর্বক বলেন, এ হাদীসসমূহ সার্বিক ভাবে ঐ সকল লোকের বিরুদ্ধে একটি শক্ত দলীল যারা মনে করেন যে, মধ্য শাবানের রাতের মর্যাদা সম্পর্কে কোন হাদীস প্রমাণিত হয়নি।

শবে বরাতের নামাজের নিয়ম. শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে হাদিস

তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে শাইখ মুহাম্মাদ নাসির উদ্দীন আলবানী বলেন, হাদীসটি সহীহ বা বিশুদ্ধ। হাদীসটি অনেক (৮ জন) সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যা একটি অন্যটিকে শক্তিশালী হতে সহায়তা করে।

সিরিয়ার প্রখ্যাত আলেম আল্লামা জামাল উদ্দিন কাসেমী (১৩৩২ হি/১৯১৪ খৃ) ও অন্যান্য কতিপয় আলিম বলেন যে, মধ্য শাবানের ফযীলত সম্বন্ধে কোন বিশুদ্ধ হাদীস নেই। এর প্রতিবাদ করে আলবানী বলেন, বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হওয়ায় এবং কঠিন দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকায় হাদীসটি নিঃসন্দেহে বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই শায়খ কাসিমীর উপরোক্ত বক্তব্য সঠিক নয়। এছাড়া অন্য যে আলিমই এ ধরনের ঢালাও মন্তব্য করেছেন তাদের সকলের কথাই অগ্রহণযোগ্য। ব্যস্ততা বা গভীর অনুসন্ধানের অভাবের কারণেই তারা এরূপ মন্তব্য করেছেন। 

২. শবে বরাতে ভাগ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত হাদীস

মধ্য-শাবানের রাত্রি বা লাইলাতুল বারাআতের ফযীলতে বর্ণিত দ্বিতীয় প্রকার হাদীসগুলিতে এ রাত্রিতে হায়াত-মউত ও রিজিক নির্ধারণের কথা উল্লেখ রয়েছে। এই অর্থে বর্ণিত হাদীস গুলোর মধ্যে রয়েছে:

হাদীস নং ১০: 

জন্ম-মৃত্যু লেখা, কর্ম উঠানো ও রিযিক প্রদান

আয়েশার (রা) সূত্রে কথিত যে, মধ্য শাবানের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ সাঃ তাকে বলেন, তুমি কি জানো আজকের রাত্রিটা কোন রাত্রি? তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, এ রাত্রে কি আছে? তখন তিনি বলেন,

এ রাতে চলতি বছরে জন্মগ্রহণকারী আদম সন্তানদের নাম এবং চলতি বছরে মৃত্যুবরণকারী আদম সন্তানদের নাম লিপিবদ্ধ করা। হয়। এ রাতে আদম সন্তানদের আমল উঠিয়ে নেয়া হয় এবং তাদের রিযিক অবতীর্ণ হয়।

হাদীসটি খতীব তাবরেযী (৭৫০ হি) “মিশকাতুল মাসাবীহ” গ্রন্থে উদ্ধৃত করে বলেন, বায়হাক্বী তার ‘আদ-দাওয়াতুল কাবীর’ নামক গ্রন্থে হাদীসটি সংকলন করেছেন। ইমাম বাইহাকী নিজেই বলেছেন যে, হাদীসটির সনদে অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারী রয়েছে। উপরন্তু হাদীসটির মূল বর্ণনাকারী “আন-নাদর ইবনে কাসীর”। এ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কোন সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয় নি। তিনিই দাবি করেছেন যে, তিনি হাদীসটি নাদার ইবনে কাসীর ইয়াহইয়া ইবনু সা’দ থেকে, তিনি উরওয়া ইবনে যুবাইর থেকে তিনি আয়েশা (রা) থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

ইবনু হাজার বলেন: আন-নার ইবনু কাসীর তাবি-তাবিয়ী যুগের একজন রাবী। মুহাদ্দিসগণ তাকে দুর্বল বলেছেন। ইমাম আহমদ বলেন, এ ব্যক্তি হাদীস বর্ণনায় দুর্বল। ইমাম বুখারী বলেন: সে অত্যন্ত দুর্বল বা মুনকার হাদীস বর্ণনা করেছে। তিনি আরাে বলেন: তার বিষয়ে আপত্তি রয়েছে। একেবারে দুর্বল বা মিথ্যাবাদী বর্ণনাকারীদের বিষয়েই ইমাম বুখারী বলেন যে, “তার বিষয়ে আপত্তি আছে”। ইমাম নাসাঈ বলেন: লোকটি চলনসই। ইমাম ইবনু হিব্বান বলেন: এ ব্যক্তি নির্ভরযোগ্য রাবীদের থেকে জাল হাদীস বর্ণনা করতেন। উকাইলি, দোলাবী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসও তাকে দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন।

এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসটির সনদ অত্যন্ত দুর্বল।

হাদীস নং ১১: 

চার রাত্রিতে ভাগ্য লিখন। 

আয়েশার (রা) সূত্রে কথিত যে, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন:

মহান আল্লাহ চার রাতে হায়াত, মউত ও রিজিক লিপিবদ্ধ করেন। মধ্য শাবান, ঈদুল আযহা, ঈদুল ফিতর ও আরাফার রাতে।

এ হাদীসটি ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫৫ হি) তার যয়ীফ ও মিথ্যাবাদী রাবীদের জীবনী গ্রন্থ লিসানুল মীযান এ উল্লেখ করেছেন। তিনি আহমদ ইবনু কা’ব আল ওয়াছেতী নামক ৪র্থ হিজরী শতাব্দীর একজন দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য রাবীর জীবনীতে এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, আহমদ ইবনু কা’ব বর্ণিত বাতিল ও মুনকার হাদীস গুলোর মধ্যে এ হাদীসটি অন্যতম। ইবনে হাজার আরো বলেন: ইমাম দারাকুতনী (৩৮৫ হি) তার ‘গারাইব মালিক’ নামক গ্রন্থে এ হাদীসটি আহমদ ইবনে কাব হতে, ইমাম মালিকের সূত্রে আয়েশা (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন এবং বলেছেন, এ হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এর সনদের মধ্যে ইমাম মালেকের পরে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা সকলেই দুর্বল বা অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী।

হাদীস নং ১২: 

রিজিক অবতরণ ও হাজীদের তালিকা প্রণয়ন 

আয়েশার (রা) সূত্রে কথিত যে, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,

মহান আল্লাহ মধ্য-শাবানের রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। অতঃপর কালব সম্প্রদায়ের মেষপালের সমান সংখ্যক অথবা মেষপালের পশমের সমান সংখ্যক লোককে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করেন এবং বছরের রিযিক নির্ধারণ করেন ও হাজীদের তালিকা লিপিবদ্ধ করেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী অথবা শিরকে জড়িত অথবা বিদ্বেষী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।

এ হাদীসটি আহমদ বিন ইবরাহীম আবু বকর আল ইসমাঈলী (মৃত্যু-৩৭১ হি.) তার মু’জামুশ শুহূখ’ বা শিক্ষকদের জীবনী গ্রন্থে উল্লেখ করেন। তিনি তাঁর শায়খ আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে হুসায়ন ইবনু হাফস আল-আশনানী আলকুফীর জীবনিতে বলেন, আমাদেরকে আবু জাফর আশনানী হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি আব্বাদ ইবনে আহমদ ইবনে আব্দুর রহমান আল-আরজামী থেকে, তিনি তাঁর চাচা (মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আল আরজামী) থেকে তিনি তার বাবা (আব্দুর রহমান আল আরজামী) থেকে, তিনি মুতাররেফ থেকে, তিনি শা’বী থেকে, তিনি উরওয়াহ থেকে, তিনি আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেন। 

এ হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল এবং বানোয়াট পর্যায়ের। একদল অত্যন্ত যয়ীফ ও পরিত্যক্ত রাবীর নামে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। আব্বাদ বিন আব্দুর রহমান, তাঁর চাচা মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান ও তাঁর পিতা আব্দুর রহমান আল- আরজামী সকলেই অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী। ইমাম দারাকুতনী তাদের সম্পর্কে বলেন, মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মদ আল-আরজামী: তিনি, তাঁর পিতা ও তাঁর দাদা সকলেই দুর্বল ও পরিত্যক্ত, অর্থাৎ মিথ্যা হাদিস বর্ণনার অভিযোগে অভিযুক্ত।

ইমাম বুখারী বলেন, তাকে (মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান) ইবনুল মুবারক ও ইয়াহইয়া বিন মাঈন পরিত্যাগ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, আরজামী পরিত্যাজ্য, আমরা তাকে গ্রহণ করি না। ইয়াহইয়া বিন মাঈন বলেন, মুহাম্মাদ বিন উবায়দুল্লাহ আল আরজামী দুর্বল। তার হাদীস লিপিবদ্ধ করা ঠিক নয়। ইমাম দারাকুতনী বলেন, আব্বাদ বিন আহমদ আল আরজামী- যার কাছ থেকে আলী বিন আব্বাস রেওয়ায়েত করেছেন- পরিত্যাজ্য বা মিথ্যা হাদিস বলার অভিযোগে অভিযুক্ত।

হাদীস নং ১৩: 

মালাকুল মাউতকে মৃতদের নাম জানানো 

তাবিয়ী রশিদ ইবনে সা’দ থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,

মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ মৃত্যুর ফেরেশতাকে উক্ত বছরে যাদের মৃত্যু নির্ধারিত তাদের সম্পর্কে অবহিত করেন।

হাদিসটি ইমাম সুয়ুতী (৯১১ হি) ইমাম দীনাওরীর ‘আল-মুজালাসা’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর ‘আল-জামি’ আস-সাগীর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, হাদীসটি দীনাওরী রাশিদ ইবনু সাদ থেকে মুরসাল রূপে সংকলন করেছেন। সুয়ূতী হাদীসটি যয়ীফ বলে উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানীও হাদীসটিকে জয়ীফ বা দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন।

মধ্য শাবানের রাতে ভাগ্য লিখন বিষয়ে এই চারটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, হাদিস গুলো সবই অত্যন্ত যয়ীফ। এখানে উল্লেখ্য যে, মধ্য শাবানের রাত বা শাবান মাসের অন্য কোন দিন বা রাত নির্ধারিত ভাবে উল্লেখ না করে সাধারণভাবে শাবান মাসে হায়াত, মউত ও রিজিক নির্ধারণের ব্যাপারে আরো কতিপয় হাদীস বর্ণিত হয়েছে।