বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; রোজার রুকন বা ফরজ হলো দুইটি; যার প্রথমটি হলো নিয়ত। রোজার নিয়ত হল, মহান আল্লাহর আদেশ পালন করার উদ্দেশ্যে রোজা রাখার জন্য হৃদয় বা অন্তরের সংকল্প।
রোজার নিয়ত
মহান আল্লাহ বলেন,
তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। এটাই সঠিক ধর্ম।
কুরআন ৯৮/৫
আর মহানবী সঃ বলেন,
সমস্ত কর্ম নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং মানুষের তাই প্রাপ্য হয় যার সে নিয়ত করে।
সহীহ বুখারী হাদিস নং ১
সুতরাং যে ব্যক্তি ফরয (যেমন রমযান, কাযা, অথবা কাফফারার) রোজা রাখবে, সে ব্যক্তির জন্য নিয়ত করা ওয়াজিব; আর নিয়ত হল, হৃদয়ের কাজ; তার সাথে মুখের কোন সম্পর্ক নেই; তার প্রকৃতত্ব হল, মহান আল্লাহর আদেশ পালন এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করার উদ্দেশ্যে কোন কাজের সংকল্প করা; বলা বাহুল্য, নাওয়াইতু আন আসূমা গাদাম মিন শাহরি রামাযান’ বলে নিয়ত পড়া বিদআত; আসলে যে ব্যক্তি মনে মনে এ কথা জানবে যে, আগামী কাল রোজা, অতঃপর রোযা রাখার উদ্দেশ্যে সে সেহরি খাবে, তার এমনিই নিয়ত হয়ে যাবে। তদনুরূপ যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিশুদ্ধ চিত্তে দিনের বেলায় (ফজর উদয় কাল থেকে সূর্য অস্ত কাল পর্যন্ত) সকল প্রকার রােযা নষ্টকারী জিনিস থেকে বিরত থাকার সংকল্প করবে, তার নিয়ত হয়ে যাবে, যদিও সে সেহরি খেতে সুযোগ না পেয়েছে।
অবশ্য নিয়ত ফজরের পূর্বেই হওয়া জরুরী। রাত্রের যে কোন অংশে করলে যথেষ্ট ও বৈধ হবে।
হাফসা (রাঃ) বলেন,
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ফজরের পূর্বেই যে লোক রোযা থাকার নিয়্যাত করেনি তার রোযা হয়নি।
জামে আত তিরমিজী হাদিস নং ৭৩০
পক্ষান্তরে সাধারণ নফল রোজার ক্ষেত্রে রাত থেকে নিয়ত করা শর্ত নয়; বরং ফজর উদয় হওয়ার পর কিছু না খেয়ে থাকলে দিনের বেলায় নিয়ত করলেও তা যথেষ্ট হবে।
আয়িশা (রাঃ) বলেন,
একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট এসে বললেন, তোমাদের নিকট কোন কিছু আছে কি? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাহলে আমি সিয়াম পালন করছি; এরপর আরেক দিন তিনি আমাদের কাছে এলেন। আমরা বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের জন্য হায়স (ঘি এবং পনির মিশ্রিত খেজুর) হাদিয়া পাঠান হয়েছে; তিনি বললেন, তুমি তা আমাকে দেখাও, আমার তো ভোর হয়েছে সায়িম অবস্থায়; তারপর তিনি তা আহার করলেন।
সহীহ মুসলিম হাদিস নং ২৬০৫
পরন্তু নির্দিষ্ট নফল (যেমন আরাফা ও আশুরার) রোজার ক্ষেত্রে পূর্ব সতর্কতামূলক আমল হল, রাত থেকেই তার নিয়ত করে নেওয়া।
রমজানের রোজাদারের জন্য রমজানের প্রত্যেক রাতে নিয়ত নবায়ন করার প্রয়োজন নেই; বরং রমজান আসার শুরুতে সারা মাস রোজা রাখার একবার নিয়ত করে নিলেই যথেষ্ট; সুতরাং যদি ধরে নেওয়া হয় যে, এক ব্যক্তি রমজানের কোন দিনে সূর্য ডোবার আগে ঘুমিয়ে গেল; অতঃপর পরের দিন ফজর উদয় হওয়ার পর তার চেতন হল; অর্থাৎ, সে রাতে এই দিনের রোজা রাখার নিয়ত করার সুযোগ পেল না। কিন্তু তবুও তার রোজা শুদ্ধ হবে। কারণ, মাসের শুরুতে সারা মাস রোজা রাখার নিয়ত তার ছিল।
হ্যা, তবে যদি কেউ সফর, রোগ অথবা অন্য কোন ওযরের ফলে মাঝে রোজা না রেখে নিয়ত ছিন্ন করে ফেলেছে তার জন্য অবশ্য ওযর দূর হওয়ার পর নতুন করে রোজা রাখার জন্য নিয়ত নবায়ন করা জরুরী।
যে ব্যক্তি খাওয়া অথবা পান করার সংকল্প করার পর পুনরায় স্থির করল যে, সে ধৈর্য ধরবে। অতএব সে পানাহার করল না। এমন ব্যক্তির রােযা কেবলমাত্র পানাহার করার ইচ্ছা ও সংকল্প হওয়ার জন্য নষ্ট হবে না। আর এ কাজ হল সেই ব্যক্তির মত, যে নামাযে কথা বলতে ইচ্ছা করার পর কথা বলে না, অথবা (হাওয়া ছেড়ে) ওযু নষ্ট করার ইচ্ছা হওয়ার পর ওযু নষ্ট করে না। যেমন এই নামাযীর ঐ ইচ্ছার ফলে নামায বাতিল হবে না এবং তার ওযুও শুদ্ধ থাকবে, অনুরূপ ঐ রোজাদারের পানাহার করার ইচ্ছা হওয়ার পর পানাহার না করে তার রােযাও বাতিল না হয়ে শুদ্ধ থাকবে। যেহেতু নীতি হল, যে ব্যক্তি ইবাদতে কোন নিষিদ্ধ (ইবাদত নষ্টকারী) কর্ম করার সংকল্প করে, কিন্তু কার্যত তা করে না, সে ব্যক্তির ইবাদত নষ্ট হয় না।
পক্ষান্তরে যে (রােযা নাই বা রাখলাম না মনে করে) নিয়ত ছিন্ন করে দেয়, তার রোযা বাতিল।
যেহেতু মহানবী সঃ বলেন, সমস্ত কর্ম নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং মানুষের তাই প্রাপ্য হয় যার সে নিয়ত করে।
সহীহ বুখারী হাদিস নং ১
যদি কোন রোজাদার মুরতাদ হয়ে যায় তাহলে সাথে সাথে তওবা করলেও তার রোযা নষ্ট হয়ে যায়। কারণ, মুরতাদের কাজ ইবাদতের নিয়ত বাতিল ও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আর এতে কারাে কোন প্রকারের দ্বিমত নেই।
নিয়ত প্রসঙ্গে আলোচনায় একটি সতর্কতা জরুরী এই যে, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ওয়াজিব হল, আল্লাহর প্রতি ঈমান, তার সওয়াবের আশা এবং কেবল তারই সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে রোজা রাখা। কাউকে দেখাবার বা শােনাবার উদ্দেশ্যে, অথবা কেবলমাত্র লোকের দেখাদেখি অন্ধ অনুকরণ করে, অথবা দেশ বা পরিবারের পরিবেশের অনুকরণ করে রোযা রাখা উচিত নয়। (যেমন রােযা শরীর ও স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী বলে সেই উপকার লাভের উদ্দেশ্যেই রোজা রাখা)। বরং ওয়াজিব হল, তাকে যেন তার এই ঈমান রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করে যে, মহান আল্লাহ তার উপর এই রোজা ফরয করেছেন এবং সে তা পালন করে তার কাছে প্রতিদানের আশা করে।
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ঈমানসহ পূণ্যের আশায় রমযানের সিয়াম ব্রত পালন করে, তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।
সহীহ বুখারী হাদিস নং ৩৮
সুতরাং রােযার উদ্দেশ্য ক্ষুৎপিপাসা ও কষ্ট সহ্য করার পর শরীর-চর্চা বা স্বাস্থ্য অনুশীলন নয়, বরং তা হল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে প্রিয়তম বস্তু ত্যাগ করার উপর আত্মার অনুশীলন।
রােযায় পরিত্যাজ্য প্রিয়তম বস্তু হল, পানাহার ও স্ত্রী-সঙ্গম। আর তা হল আত্মার কামনা। প্রিয়তমের সন্তুষ্টি হল, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। সুতরাং নিয়তে আমরা যেন এ কথা স্মরণে রাখি যে, আমরা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় উক্ত রােযা নষ্টকারী (কামনার) বস্তু ত্যাগ করব।