ফেরা pdf

ফেরা Pdf Book Details

ফেরা pdf

লেখকসিহিন্তা শরীফা
ধরনইসলামী সাহিত্য
ভাষাবাংলা
প্রকাশকসমকালীন প্রকাশন
প্রকাশকাল*
পৃষ্ঠা১২১
ফাইল সাইজ৪৩.৮ MB
ফাইল টাইপPDF

ফেরা Pdf Book Description

আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার! আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ

সাউণ্ড বন্ধ করো! সাউন্ড বন্ধ করো! তোমরা কেউ সাউন্ড কমিয়ে দিচ্ছ না কেন?

বয়স তখন পাঁচ কি হয়। ঈদের দিন বাবা-মায়ের সাথে বেড়াতে এসেছি দাদির বাড়ি। দেশের একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভি তে তখন প্রতিদিন পাঁচবার করে আযান শোনা যেত। সব সময় দেখে এসেছি আমাদের বাসায় আযানের সময়টুকু সাউন্ড মিউট করে রাখা হয়। তাই দাদির বাড়িতে সবাই চুপচাপ টিভিতে আযান শুনছে দেখে এভাবেই চিৎকার করে উঠলাম আমি। এতগুলো মানুষের সামনে আমার অপ্রস্তুত বাবা-মা সেদিন পরিস্থিতি কেমন করে সামাল দিয়েছিলেন মনে নেই—তবে সেদিনের পর থেকে এটা বুঝে গিয়েছিলাম যে ওরা আর আমরা এক নই। ওরা মুসলিম, আমরা খ্রিষ্টান।

ঈদের দিন আমাদের কাউকে নতুন জামা কিনে দেওয়া হতো না; অথচ বড়দিন, নতুন বছরের প্রথম দিন অথবা ইস্টার সানডে তে নতুন জামা পরলেও দাদির বাড়ি যাওয়া হতো না। কারণ একটাই। আমরা খ্রিষ্টান, ওরা মুসলিম।

বাবা, মা আর দুই বোন নিয়ে একটি সুখী পরিবার ছিল আমার। ছোট ভাইয়ের জন্ম হয়নি তখনও। আমরা নানার বাড়ির অদূরে একটি ভাড়া বাড়িতে ছিলাম। মায়ের দিকের প্রায় সব আত্মীয়-স্বজন কাছাকাছি থাকতেন খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকাটিতে। জন্মের পর থেকেই জেনে এসেছি আমি একজন খ্রিষ্টান, রোমান ক্যাথলিক। বাবা-মা যে খুব বেশি ধর্মপরায়ণ ছিলেন তা না। তবে তারা নিজেদের খ্রিষ্টান বলেই দাবি করতেন।

সারাজীবনে দাদাকে দেখেছি হাতে গোনা কয়েকবার। ঈদের দিন মাঝে মাঝে নিয়ে যেতেন বাবা। দাদার পরিবার খ্রিষ্টান না, এটা জানার আর বোঝার পর আমার প্রতিক্রিয়া কী ছিল মনে নেই। ছোট ছিলাম বলেই হয়তো ওই সময়ে অত কিছু আর ভাবা হয়নি ওই ব্যাপারে। আসলে তাদের নিয়ে ছেলেবেলার তেমন কোনাে স্মৃতি মনে পড়ে না আমার।

শুনেছিলাম বাবা নাকি আমার মাকে ভালােবেসে মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও খ্রিষ্টান হয়েছিলেন, যেন মাকে বিয়ে করতে পারেন। যদিও বাপ-দাদার ধর্ম হিসেবে ইসলামের প্রতি খানিকটা হলেও শ্রদ্ধা ছিল তার। কখনাে কখনাে নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। সে সময় তিনি একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যার কাছে ইসলামধর্মের প্রশংসা শুনতাম। মুসলিম পরিবারে জন্ম বলেই হয়তাে ওই ধর্মকে ভালাে মনে করতেন। কখনাে দেখিনি তাকে ধর্মীয় উৎসব ছাড়া খ্রিষ্টধর্ম বা অন্য কোনাে ধর্মের আর কিছু পালন করতে। অনেক আগে একবার আমাদের সাথে গির্জায় নিয়ে গেলেন মা। মিসায় কী কী বলতে হয় কিছুই পারলেন না বাবা। বেশ মজা পেলাম তখন। আমি যা পারি বাবা তা পারেন না।

ছেলেবেলা থেকে আমার কাছের বন্ধুরা সবাই ছিল হিন্দু নয়তাে খ্রিষ্টান। আমার পরিবারের লােকজনেরও খ্রিষ্টান কমিউনিটির বাইরে খুব একটা মেলামেশা ছিল। না। আর তাই সত্যিকার মুসলিমদের জীবনধারা সম্পর্কে আমার তেমন কোনাে ধারণাই ছিল না তখন। তাদের সম্পর্কে সব সময় একটা খারাপ মনােভাব নিয়ে বেড়ে উঠছিলাম। শিক্ষাক্ষেত্রে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবে, ছােটখাটো অথচ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার কারণে ধীরে ধীরে ধর্ম সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ধারণা বদলে গিয়েছিল। শৈশবেই ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হওয়ার সাথে জন্ম নিয়েছিল খ্রিষ্টধর্মের প্রতি ভালােবাসা।

আমাকে নিয়ে বাবা-মা একবার মায়ের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তখন আমি খুবই ছােট। বাবা ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান—এ খবর পেয়ে গ্রামের লােকজন নাকি তাকে মারতে চলে এসেছিল। জান নিয়ে কোনােরকমে পালিয়ে এসেছিলেন। তারা। এরপর আর কখনাে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি আমার। তবে বড় হয়ে যখন এই ঘটনা শুনলাম, তখন এর সারমর্ম আমার কাছে এই ছিল যে মুসলিমরা খুব খারাপ। আমার বাবাকে মারতে চেয়েছিল এরা, অথচ এদের তাে কোনাে ক্ষতি করেননি তিনি। শুধু তাদের ধর্ম ছেড়ে দিয়েছে বলে একটা মানুষকে মারবে?

বয়স তখন ছয় বছর আমার, ভাইটা প্রিমাচিওর্ড হওয়াতে মাকে বেশ কয়েকদিন থাকতে হলাে হাসপাতালে। আমাকে নানির বাসায় আর ছােট বােনকে দাদির বাসায় রেখে বাবা অন্য কাজে ব্যস্ত। পরে বাসায় ফেরার পর শুনি আমার চেয়ে দেড় বছরের ছােট বােনটা দাদির সাথে সলাত পড়া শিখে ফেলেছে। সবাই হেসেই উড়িয়ে দিল ব্যাপারটা। আমিও মজা পেলাম। ওর কাছ থেকে দেখে নিলাম কীভাবে পড়েছিল ও। ব্যায়ামের মতাে করে উঠা-বসা করতে হয়, আর আল্লাহ আল্লাহ বলতে হয়। অদ্ভুত লাগল, আমাদের ধর্মে তাে এ ধরনের কিছু করতে হয় না। সেই প্রথম আমি মুসলিমদের সলাত সম্পর্কে ধারণা লাভ করলাম।

ছােট ভাইয়ের জন্মের আগে আমাদের বাসা পরিবর্তন করা হয়েছিল। একই এলাকায়। বাসাটা ছিল নীচতলাতে। একদিন বারান্দায় বসে খেলছিলাম আমি। বড়রা কেউ ছিল না আশেপাশে। আপাদমস্তক কালাে জামা পরা কে যেন এসে দাঁড়ালেন বারান্দার ওপাশে। হাত তুলে ডাকলেন আমাকে। ভয়ে চিৎকার করে দৌড়ে পালালাম। আমার দেখা প্রথম হিজাবি মহিলা। হয়তাে কালাে বােরখা পরা কোনাে। এক প্রতিবেশিনী এসেছিলেন নতুন ভাড়াটেদের সাথে পরিচিত হতে।

মাসজিদে আযান শােনা গেলে আমিও আযান দেওয়া লােকটার সাথে সাথে গাইতাম। মা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিতেন কেন বুঝতাম না। শুনেছিলাম মা নাকি ছােটবেলায় আযান শুনে ভয় পেতেন।

ছেলেবেলায় পরিবার, স্কুল আর বিভিন্ন বইপত্র থেকে এই শিক্ষা পেয়েছিলাম যে মুসলিমরা খারাপ আর আমরা ভালাে। টিভি-পত্রিকার অপরাধ বিষয়ক খবরগুলাে দেখিয়ে বলা হতাে যত সব অন্যায় কাজ মুসলিমরাই করে। কখনাে শুনেছ আমাদের খ্রিষ্টান কোনাে ছেলে চুরি করেছে বা সন্ত্রাসী হয়েছে? ধর্ম ক্লাসে ওদের বিরুদ্ধে প্রায়ই শুনতে হতাে। ওরা হলাে ক্ষতিকর লাল পিপড়া আর আমরা নিরীহ কালাে পিপড়া।

ক্যাথলিক চার্চকে এদেশে খ্রিষ্টমণ্ডলী বলা হয়। মণ্ডলীর প্রত্যেক সদস্যকে সাতটা sacrament নির্দিষ্ট বয়সে, নির্দিষ্ট সময়ে পালন করতে হয়। প্রথমটা হলাে baptism (দীক্ষাস্নান), যা দ্বারা একটি শিশুকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়, অর্থাৎ তাকে খ্রিষ্টান বানানাে হয়। এদিনে তার নাম রাখা হয়; ধর্ম-বাবা, ধর্ম-মা নির্ধারণ হয়—যারা শিশুটির বাবা-মায়ের অবর্তমানে তার দেখাশােনা, ভরণ-পােষণ, ধর্মীয় শিক্ষা ইত্যাদির দায়িত্ব নিতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। খ্রিষ্টধর্মের বিশ্বাস অনুসারে প্রত্যেক মানবশিশু আদমের যে ‘আদিপাপ’ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, দীক্ষাগান তার সেই পাপ মােচন করে। জন্মের একুশ দিন পর আমাকেও বেশ ঘটা করে baptised করা হলো। নাম রাখা হলাে কর্নেলিয়া স্টেফানি ম্যান্ডে।

একটু বড় হলে মা যখন ভর্তি করিয়ে দিলেন একটা খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলে, সেখান থেকেই শিখতে লাগলাম ধর্মের যাবতীয় নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি। ক্যাথলিক রীতি অনুসারে এর পর এক এক করে বিভিন্ন বয়সে Confirmation, Eucharist আর Penance সম্পন্ন করলাম। প্রত্যেকটা স্যাক্রামেন্টের আগে কয়েক সপ্তাহ ধর্ম ক্লাসে যেতে হতাে।

সে সময় রবিবারে নিয়মিত গির্জায় যেতাম, ভক্তির সাথে খেতাম ওয়াইনে ভেজানাে রুটির টুকরাে—ওয়াইন যিশুর রক্ত আর রুটি যিশুর মাংসকে প্রতিনিধিত্ব করে। চার্চের ফাদারের কাছে গিয়ে পর্দার আড়ালে হাঁটু গেড়ে ‘পাপ-স্বীকার করতাম নিয়মিত। ধর্ম ক্লাসে যেতাম, প্রচুর ধর্মের বই পড়তাম। প্রায় সব প্রার্থনা’ মুখস্থ ছিল আমার। রাতে ঘুমানাের সময় ছােট বােনকে সাথে নিয়ে rosary মালা হাতে হাঁটু গেড়ে ঘণ্টাখানেক প্রার্থনা করতাম। বেচারি প্রার্থনারত অবস্থায় পুরােটা শেষ হওয়ার আগে ঘুমিয়ে পড়ত প্রায়ই।

বেশ কিছু ধর্মীয় বই সংগ্রহে ছিল আমার। সাধু-সাধ্বী আর প্রেরিত ভাববাদীদের কাহিনি—অ্যাডাম, নােয়াহ, আব্রাহাম, যােসেফ, ডেভিড, যােনা, মােশি আর যিশু। ছিল বাইবেলের একটি ইংরেজি ভার্শনের সাধু আর চলিত দুইটি ভিন্ন রীতির বাংলা অনুবাদ। প্রায় প্রতিদিন পড়তাম সেগুলাে, নােট করে করে। নিজেকে খ্রিষ্টান হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববােধ করতাম।

শৈশব-কৈশােরে বেশ ধর্মপরায়ণ ছিলাম আমি। বিশ্বাস করতাম, একসময় আমাদের পাপ-পুণ্যের হিসেব নেওয়া হবে। মনে-প্রাণে বিশ্বাস ছিল পুনরুত্থান দিবস, শেষ বিচার আর অনন্তজীবনে। বাবা-মায়ের অবাধ্য হওয়া চলবে না, তাদের কট দেওয়া যাবে না, মিথ্যা কথা বলা যাবে না—চেষ্টা করতাম ধর্মের প্রতিটি আদেশনিষেধ সাধ্যমতাে মেনে চলতে। ফলে, পরিচিত সবার কাছে ভালাে মেয়ে বলে সুনাম ছিল। সবাই আমাকে বিশ্বাস করত, ভালােবাসত।

খ্রিষ্টবাদ আমার রক্তে এমনভাবে মিশে গিয়েছিল যে কৈশাের পেরিয়েও আমি যেই ধর্ম মানছি সেটা সত্য নাকি মিথ্যা সেটা নিয়ে মাথা ঘামানাের কথা মাথাতেই আসেনি। মানতে হবে বলেই মানা। সবাই তাে সেই একজন সৃষ্টিকর্তাকেই ডাকে। তবে মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম। মেলাতে পারতাম না কিছু প্রশ্নের উত্তর। আর সময়ের সাথে সাথে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই একটা সময়ে এসে বদলে গিয়েছিল আমার সম্পূর্ণ জীবনধারা।

ফেরা ২ – বিনতু আদিল

রাত্রির শেষ প্রহর। সাত আসমানের অধিপতি নেমে এসেছেন প্রথম আসমানে। বান্দাদের ডাকছেন

আছে কি কোনাে তাওবাকারী, যার তাওবা আমি কবুল করব?

আছে কি কোনাে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী, যাকে আমি ক্ষমা করে দেবাে?

কেউ কি কিছু চাইছে আমার কাছে, যাকে আমি দান করব?

ঠিক এই সময়, একদম এই সময়েই আলাে জ্বলে ওঠে বিন্নুরি গার্লস মাদরাসার ২০৩ নম্বর কক্ষে।

‘মারইয়াম, উঠে পড়াে! তাহাজ্জুদের সময় হয়ে গেছে। আনুশিয়া, রুকাইয়া ওঠো! তাহাজ্জুদ পড়বে না?’

যে মেয়েটা একে একে সবাইকে ডাকছে তার নাম আয়িশা। নওমুসলিম সে। দিন পনেরাে হলাে মাদরাসায় এসেছে। সঙ্গে এসেছে তার ছােট বােন মারইয়াম।

রাত্রির শেষ প্রহরে নিয়ম করে ঘুম ভেঙে যায় আয়িশার। দু-চারটা সুরা মুখস্থ হয়েছে। সবে। ওটুকু সম্বল করেই আবেগমথিত হৃদয়ে রবের সামনে দাঁড়ায় সে। পার্থিব কোলাহলকে পেছনে ফেলে সে মগ্ন থাকে নিবিড় আলাপনে, সুমহান রবের সাথে।

কেমন করে এ জীবনে এলো আয়িশা? কেনই-বা মারইয়াম তার সঙ্গী হে তাদের তো জন্ম হয়েছিল এক হিন্দু পরিবারে। তারা তো বেড়ে উঠেছিল এক ক্ষয়িষ্ণু সমাজে—এমন এক সমাজে, যেখানে সব ধর্মের অস্তিত্ব মিলেমিশে একাকার। মুসলিমরা হোলি খেলছে, সাড়ম্বরে অংশ নিচ্ছে বসন্তপূজায়। হিন্দুরাও অভ্যস্ত মুসলিমদের জীবনাচারে। অজ্ঞতা আর মূর্খতায় ঘেরা জীবন। কেউ জানে না কোথায় যাচ্ছে, কীসের পিছনে ছুটছে সবাই।

তবুও তো এমন হয়—প্রচন্ড ঝড়ে লণ্ডভণ্ড অস্থির প্রকৃতিতে প্রাণের জোয়ার আসে। জ্বলে ওঠে জীবনের প্রদীপ। দমকা বাতাসও সে প্রদীপ নিভিয়ে দিতে পারে না। এমনই দুটি প্রদীপের নাম আয়িশা আর মারইয়াম। কী করে জ্বলে উঠল তারা? শোনা যাক আয়িশার জবানিতে।

আমাদের পরিবার

“বাবা মুসলিম, মা হিন্দু আর মেয়ে হয়েছে আধা খ্রিষ্টান— তামাশার শেষ নেই সংসারে!’

মায়ের চিৎকার আমাদের রুম থেকেও দিব্যি শোনা যাচ্ছে। নীলমের সাথে চোখাচোখি হলো আমার। ইশারায় বলে দিলাম রুমের দরজাটা যেন লাগিয়ে দেয়। তাতে যদি আওয়াজ কিছুটা কমে! খুব একটা লাভ হয়নি অবশ্য। প্রতি রাতে নিয়ম করে মায়ের আহাজারি শুরু হয়। রাত যত বাড়ে, তার চিৎকারও বাড়ে। খাবার টেবিল গুছাতে গুছাতে মা একবার না একবার এসব কথা তুলবেনই। বাবার অসহায় ম্রিয়মাণ গলা ঢাকা পড়ে যায় বাসন-কোসনের ঝনঝনানিতে।

মায়ের চ্যাঁচামেচির কোনো সমাধান নেই আসলে। মনের ঝাল মেটাতে সুযোগ পেলেই তিনি চিৎকার করেন। বাবা তার মুসলিম কর্মচারীর পাল্লায় পড়েছেন। ভদ্রলোক ভীষণ ধার্মিক, সজ্জন ব্যক্তি। দাড়ি আছে, ধর্মকর্ম করেন বেশ নিষ্ঠার সাথে। সম্প্রতি বাবাকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে বসেছেন। এখানেই ব্যাপারটা শেষ হলে চিন্তার কিছু ছিল না। চিন্তার বিষয় হলো বাবা তার দাওয়াত কবুল করে নিয়েছেন।

আমাদের পরিবারে, মায়ের ভাষায় ‘তামাশার সংসারে’ এমন খবরটা সহজভাবে নেওয়ার অবকাশ নেই। মা আমার মনেপ্রাণে হিন্দু। স্বামী মুসলিম হয়ে যাবেন—এটা মেনে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। যদিও আমরা থাকি মিশ্র এক পরিবেশে, তবুও। মিলেমিশে সব ধর্মের রীতিনীতি এক-আধটু পালন করা আর একেবারে ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়াতে তফাত আছে। আত্মীয়-সুজন মানবে না, সমাজও একঘরে করে দেবে। আর আমার মা-ও এই তফাত মানতে পারছেন না কোনােভাবেই। এজন্যই রােজ রােজ হট্টগােল।

আমাদের বর্তমান নিবাস মিরপুরখাস জেলার এক ভাড়া বাড়িতে। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের একদম সীমান্তঘেঁষা জেলা এই মিরপুরখাস। সীমান্তবর্তী বলেই এখানে হিন্দুমুসলিমের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। ধর্ম নিয়ে খুব বেশি চিন্তা-ভাবনা নেই এখানকার মানুষের। এক ধর্মের লােকেরা আরেক ধর্মের প্রথা দিব্যি মেনে চলেছে। মুসলিমরা রাখি বন্ধনের অনুষ্ঠান করছে তাে হিন্দুরা ঝাড়-ফুকের জন্য দৌড়াচ্ছে মসজিদে। আমার বড় দুই ভাইয়ের কথাই ধরা যাক। তারা রামাদানে সিয়াম রাখে, সাহরি খায়। ফজরের সালাত আদায় করে। অন্য চার ওয়াক্ত সালাতেও তাদের দেখা যায় কদাচিৎ। তাদের কথা, হিন্দু বলাে আর মুসলিম, আমাদের সবার প্রভু তাে একজনই।

বাবা আগে রাগ করতেন ভাইদের সালাত পড়তে দেখলে। এখন তিনি নিজেই মুসলিম হয়ে যেতে চাইছেন। অবশ্য মায়ের চ্যাঁচামেচিতে তার মুসলিম হবার খায়েশ ইতােমধ্যে ধামাচাপা পড়ে গেছে। ধামাচাপা পড়ে গেছে মেজো দিদির খ্রিষ্টান হবার শখও। কীজন্য সে খ্রিষ্টধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল ঠিক মনে নেই। তবে মা-বাবা তা হতে দেননি। মেজো দিদি লক্ষ্মীর বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন তড়িঘড়ি করে।

আমরা সাত ভাই-বােন। বড় দিদি আর মেজো দিদি থাকে যার যার শ্বশুরবাড়িতে। বড় দুই ভাইয়ের ছােটখাটো যৌথ ব্যবসা আছে। ব্যবসা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত তারা। বাবার মতােই দশ-পনেরাে দিন পরপর বাড়ি আসে। ভাইদের পর আমি, আমার ছােটবােন নীলম আর সবচে ছােট এক ভাই।

বড় ভাইদের মতাে বাবারও নিজস্ব ব্যবসা। মিরপুরখাসে আসার আগে আমরা থাকতাম পাশের জেলা সংহারে। বাবার ব্যবসায় লােকসান হলাে, তল্পিতল্পা গুটিয়ে। আমরা পাড়ি জমালাম মিরপুরখাসে। দুই জেলার সংস্কৃতিতে খুব একটা পার্থক্য ছিল । তাই মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়নি তেমন। মিশ্র ধর্মীয় সংস্কৃতি এখানে। যার ছাপ আমাদের পরিবারেও বেশ ভালােমতােই পড়েছে—মা ধর্মপ্রাণ হিন্দু, বাবা আর দিদি মায়ের কাছে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে হিন্দুধর্মে, আর ভাইয়েরা নিজেদের মতাে করে কখনাে ইসলাম, কখনাে হিন্দুধর্মের রীতিতে গা ভাসাচ্ছে।

এসময়টা আমার মনে হতাে পরিবারে মা বাদে বাকিরা বুঝি ইসলামের ব্যাপারে বেশ সহনশীল। সময়ের সাথে সাথে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলাে। সবার অনুরাগ ফিকে হয়ে আসতে দেখলাম নিজ চোখে। আর ইসলামকে ভালােবেসে ফেললাম আমি—যার কিনা ধর্ম নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না বললেই চলে। জানি না কোন সময়ে আমার হৃদয়ে ঈমানের ফুল ফুটেছিল।

শুরু হলাে নতুন জীবন। নিস্তরঙ্গা, নির্বিবাদী জীবন ফেলে ঝাঁপ দিলাম এক অজানা গন্তব্যে। আমার সঙ্গী হলাে নীলম। মনিকা থেকে আমি হলাম আয়িশা আর নীলম হলাে মারইয়াম।

ফেরা Pdf Writer Description

Read the Pdf Book ফেরা

Share the Pdf Book ফেরা

Rate the Pdf Book ফেরা

Rating Summary

0.0
0.0 out of 5 stars (based on 0 reviews)
Excellent0%
Very good0%
Average0%
Poor0%
Terrible0%

Latest Reviews

There are no reviews yet. Be the first one to write one.

Latest Book

Scroll to Top