বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে হাদিস শব্দের অর্থ কি, হাদিস কাকে বলে, হাদিস কত প্রকার ও কি কি, হাদিসের গুরুত্ব ইত্যাদি।
সূচিপত্র
Toggleহাদিস শব্দের অর্থ কি
হাদীস আরবী শব্দ। আরবী অভিধান ও কোরআনের ব্যবহার অনুযায়ী ‘হাদীস’ শব্দের অর্থ – কথা, বাণী, বার্তা, সংবাদ, বিষয়, খবর, ব্যাপার ইত্যাদি।
‘হাদীস’ শুধুমাত্র একটি আভিধানিক শব্দ নয়। মূলতঃ ‘হাদীস’ শব্দটি ইসলামের এক বিশেষ পরিভাষা। সে অনুযায়ী রাসূল (স.)-এর কথা, কাজের বিবরণ, কাজের সমর্থন এবং অনুমোদন যা বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত, ইসলামী পরিভাষায় তাই-ই ‘হাদীস’ নামে অভিহিত।
ব্যাপক অর্থে সাহাবীদের কথা, কাজ ও সমর্থন এবং তাবেয়ীদের কথা কাজ ও সমর্থনকেও হাদীস বলে।
কিন্তু, সাহাবা, তাবেয়ীগণের ন্যায় তাবে তাবেয়ীনের কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণও যে কোরআন হাদীসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং বাস্তব রূপায়নের দৃষ্টিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় জিনিস, তাতে সন্দেহ নেই।
যেহেতু রাসূলে করীম (স.), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী এবং তাবে তাবেয়ীগণের কথা কাজ ও সমর্থন একই মূল বিষয়কে কেন্দ্র করেই প্রচলিত, সেই জন্য মোটামুটিভাবে সবগুলিকেই ‘হাদীস’ নামে অভিহিত করা হয়।
কিন্তু তবুও শরীয়তী মর্যাদার দৃষ্টিতে এই সবের মধ্যে পার্থক্য থাকায় প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আলাদা পরিভাষা নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা- নবী করীম (স.)-এর কথা কাজ ও অনুমোদনকে বলা হয় ‘হাদীস’। সাহাবাদের কথা কাজ ও অনুমোদনকে বলা হয় ‘আছার’। তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীনদের কথা কাজ ও অনুমোদনকে বলা হয় ‘ফতোয়া’।
মতন অনুসারে হাদিস কত প্রকার
হাদীস শাস্ত্রের পণ্ডিতগণ হাদীসকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন-
১. কাওলী ২. ফে’লী ৩. তাকরীরি।
কাওলী : আদেশ, নিষেধ অথবা অন্যান্য যত প্রকার মৌখিক বর্ণনা আছে তাকে ‘হাদীসে কাওলী’ বলে।
উদাহরণ: হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসূলে করীম (স.) বলেছেন- ফাসেক ব্যক্তির প্রশংসা ও স্তুতি করা হলে আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হন এবং এ কারণে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে। (বায়হাকী)
এই হাদীসটি রাসূল (স.) এর একটি বিশেষ কথার উল্লেখ থাকার কারণে এটা কাওলী হাদীস।
ফে’লী: ‘কাজ-কর্ম, আচার-ব্যবহার, উঠা-বসা, লেন-দেন সম্পর্কীয় কথাগুলোকে হাদীসে ফে’লী বলে।
উদাহরণ : হযরত আবু মুসা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলে করীম (স.) কে মোরগের গোস্ত খেতে দেখেছি। (বোখারী ও মুসলিম)
এই হাদীসটিতে রাসূল (স.) এর একটি কাজের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এই জন্য এটি হাদীসে ফে’লী’।
তাকওয়া অর্থ কি? তাকওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা. মুত্তাকী কাকে বলে?
তাকরীরি: অনুমোদন বা সমর্থন জ্ঞাপন সূচক হাদীস। দেখা গেছে অনেক সময় সাহাবীগণ অনেক কাজ করেছেন, যে কাজের ব্যাপারে রাসূল (স.) সমর্থন দিয়েছেন অথবা মৌনতার মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছেন, এই ধরনের হাদীসকে ‘তাকরীরী হাদীস’ বলে।
সনদ অনুসারে হাদিস কত প্রকার ও কি কি
বর্ণনাকারীদের (রাবীদের) সিলসিলা অনুযায়ী হাদীসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়ঃ
ক. মারফু খ. মওকুফ গ. মাকতু
মারফু : যে হাদীসের সনদ বা সূত্র নবী করীম (স.) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে ‘মারফু হাদীস’ বলে। অর্থাৎ যে সূত্রের মাধ্যমে স্বয়ং রাসূলের কোন কথা, কোন কাজ করার বিবরণ কিংবা কোন বিষয়ের অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে, যে সনদের ধারাবহিকতা রাসূল করীম (স) থেকে হাদীস গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত সুরক্ষিত হয়েছে এবং মাঝখান থেকে একজন বর্ণনাকারীও বাদ পড়েনি তা ‘হাদীসে মারফু’ নামে পরিচিত।
মওকুফ: যদি কোন হাদীসের সনদ রাসূল (স.) পর্যন্ত না পৌঁছে, সাহাবী পর্যন্ত গিয়েই স্থগিত হয়- অর্থাৎ যা স্বয়ং সাহাবীর হাদীস বলে সাব্যস্ত হয় তাকে ‘হাদীসে মুওকুফ’ বলে।
ইমাম নববী এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন- “যাতে কোন সাহাবীর কথা কাজ কিংবা অনুরূপ কিছু বর্ণিত হয় – তা পর পর মিলিত বর্ণনাকারীদের দ্বারা বর্ণিত হোক কিংবা মাঝখানে কোন বর্ণনা কারীর অনুপস্থিতি ঘটুক তা মওকুফ হাদীস’।
মাকতু : যে হাদীসে রাবীদের ধারাবাহিকতা কোন তাবেয়ী পর্যন্ত পৌঁছেছে অর্থাৎ তাবেয়ীর হাদীস বলেই প্রমাণিত হয়েছে তাকে ‘হাদীসে মাকতু’ বলে।
সনদের ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে হাদিসের প্রকারভেদ
সনদের ধারাবাহিকতার ভিত্তিতে হাদীস দু’প্রকার যথাঃ- ১. মোত্তাছিল ২. গায়রে মোত্তাছিল।
মোত্তাসিল: যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা ওপর হতে নীচ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষিত হয়েছে, কোন রাবী বাদ বা উহ্য থাকেনি তাকে মোত্তাসিল বলে।
গায়রে মোত্তাসিল: সূত্র অসংলগ্ন অর্থাৎ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি, কোন না কোন স্থানের রাবী বাদ পড়েছে বা উহ্য রয়েছে এ ধরনের হাদীসকে ‘গায়ের মোত্তাসিল’ বলে।
হাদীসে গায়রে মোত্তাছিল আবার কয়েক প্রকার : ক, মু’আল্লাক খ. মুরসাল গ. মুনকাতা ঘ. মুদাল্লাস ঙ. মোদাল।
মু’আল্লাক: হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে যদি প্রথম অংশেই রাবী বাদ পড়ে যায় তবে তাকে ‘মু’আল্লাক হাদীস’ বলে।
মুরসাল: হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে যদি সনদের শেষাংশের রাবীর নাম বাদ পড়ে যায় তবে তাকে ‘মুরসাল’ বলে।
মুনকাতা: অসংলগ্ন সূত্রের অর্থাৎ বর্ণনার সময় রাবী বাদ পড়েছে এমন যে কোন হাদীসকে ‘মুনকাতা’ বলা যায়। ইনকাতা শব্দের আভিধানিক অর্থ ছিন্ন হওয়া। অতএব প্রত্যেক ছিন্ন সূত্রের হাদীসকে ‘মুনকাতা’ বলা যেতে পারে।
মো’দাল: হাদীস বর্ণনার সময় যদি সনদ থেকে দুই বা ততোধিক রাবী বাদ পড়ে যায় তবে তাকে মোদাল বলে।
মুদাল্লাম: যে হাদীসের রাবী নিজের প্রকৃত শায়খের নাম না করে তাঁর ওপরস্থ শায়খের নামে এরূপভাবে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে মনে হয় তিনি নিজেই তা উপরিউক্ত শায়খের নিকট থেকে শুনেছেন অথচ তিনি নিজে তা তাঁর নিকট থেকে শুনেননি (বরং তা তাঁর প্রকৃত উস্তাদের নিকট শুনেছেন) সে হাদীসকে মুদাল্লাছা বলে এবং এইরূপ করাকে ‘তাদলীস’ বলে। আর যিনি এইরূপ করেছেন তাঁকে ‘মুদাল্লেছ’ বলে। মুদাল্লেসের হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়- যে পর্যন্ত না তিনি একমাত্র ছেকাহ রাবী হতে তাদলীছ করেন বলে সাব্যস্ত হন অথবা তিনি তা আপন শায়খের নিকট শুনেছেন বলে পরিষ্কারভাবে বলে দেন।
বর্ণনার দুর্বলতার জন্য হাদিসের প্রকারভেদ
এ ধরনের হাদীস আবার কয়েক প্রকার
১. মুজতারাব ২. মুদরাজ ৩. মাকলুব ৪. শা’জ ৫. মুনকার ৬. মুআল্লাল।
মুজতারাব: যদি কোন রাবী হাদীস বর্ণনার সময় সনদ ওলট পালট করে যেমন আবু হুরাইরার স্থানে আবু যুবাইর বললেন বা এক স্থানের শব্দ অন্য স্থানে লাগালেন অথবা একজনের নিকট একটি হাদীস একরকম বর্ণনা করে অন্য লোকের নিকট ঐ হাদীসই আবার আরেক রকম বর্ণনা করলেন এই ধরনের হাদীসকে ‘মুজতারাব’ বলে। এটা গ্রহণযোগ্য হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত না এর সঠিকতা প্রমাণিত হয়। মুদরাজ : যদি কোন রাবী হাদীস বর্ণনা করার সময় নিজের কথা অথবা অন্য কারো কথা শামিল করে দেয় তাঁর সেই হাদীসকে ‘মুদরাজ’ বলে। আর এইরূপ করাকে ‘ইদরাজ’ বা শামিল করা বলে। যদি ঐ কথা হাদীসের কোন শব্দকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় তা’হলে তা জায়েয, নতুবা হারাম।
মাকলুব: যদি কোন রাবী হাদীস বর্ণনার সময় এক মতনের সনদকে অন্য মতনে জুড়ে বর্ণনা করেন তবে তাকে ‘মাকলুব’ বলে। এরূপ কোন ঘটনা ঘটলে ঐ রাবীর স্মরণ শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এ প্রকার রাবীর বর্ণনাকৃত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। তবে যাচাই বাছাই করার পর গ্রহণ করা যেতে পারে।
মাহফুজ ও শা’জ:
কোন ছেকাহ রাবীর হাদীস অপর কোন ছেকাহ-রাবী বা রাবীগণের হাদীসের বিরোধী হলে, যে হাদীসের রাবীর ‘জবত’ গুণ অধিক বা অপর কোন সূত্র দ্বারা যার হাদীসের সমর্থন পাওয়া যায় অথবা যার হাদীসের শ্রেষ্ঠত্ব অপর কোন কারণে প্রতিপাদিত হয় তাঁর হাদীসটিকে হাদীসে মাহফুজ এবং অপর রাবীর হাদীসটিকে হাদীসে শা’জ বলে এবং এরূপ হওয়াকে ‘শুজুজ’ বলে। ‘শুজ’ হাদীসের পক্ষে একটি মারাত্মক দোষ। শা’জ হাদীস সহীহ রূপে গণ্য নহে।
মুনকার: জবত গুণ সম্পন্ন নয় এরূপ কোন ব্যক্তি এমন কোন হাদীস বর্ণনা করলো যা অন্য কারো নিকট থেকে শোনা যায়নি এরূপ হাদীসকে ‘মুনকার’ হাদীস বলে। যে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হয়েছে অথবা কোন গুনাহের কাজে লিপ্ত রয়েছে এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীসকে ‘মাতরুক’ বা পরিত্যক্ত হাদীস বলে।
মু-আল্লাল: যে হাদীসের ভেতর অত্যন্ত সূক্ষ্ম ত্রুটি থাকে যা হাদীসের সাধারণ পণ্ডিতগণ ধরতে পারে না, একমাত্র সুনিপুণ শাস্ত্র বিশারদ ব্যতিরেকে। এই প্রকার হাদীসকে ‘মু-আল্লাল’ বলে। এ এরূপ ত্রুটিকে ‘ইল্লত’ বলে। ‘ইল্লত’ হাদীসের পক্ষে মারাত্মক দোষ, এমনকি ‘ইল্লত যুক্ত হাদীস সহী হতে পারে না।
রাবীদের যোগ্যতা অনুসারে হাদিসের প্রকারভেদ
রাবীদের যোগ্যতা অনুসারে হাদীস তিন প্রকার-
১. সহীহ ২. হাসান ৩. জয়ীফ
সহীহ: যে মুত্তাসিল সনদের রাবীগণ প্রত্যেকেই উত্তম শ্রেণীর আদিল ও জাবিতরূপে পরিচিত অর্থাৎ ছেকাহ হওয়ার শর্তাবলী তাদের মধ্যে পূর্ণরূপে বিরাজমান, মূল হাদীসটি সূক্ষ্ম দোষ ত্রুটি অথবা শা’জ বা দল ছাড়া হতে মুক্ত এরূপ হাদীসকে ‘সহীহ হাদীস’ বলে। অন্যভাবে বলা যায় যে হাদীসের বর্ণনা সূত্র ধারাবাহিক রয়েছে, সনদের প্রত্যেক স্তরের বর্ণনাকারীর নাম সঠিকরূপে উল্লেখিত হয়েছে, বর্ণনাকারীগণ সর্বোতভাবে বিশ্বস্ত ছেকাহ যাঁদের স্মরণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর এবং যাঁদের সংখ্যা কোন স্তরেই মাত্র একজন হয়নি, এরূপ হাদীসকে হাদীসে সহীহ বলে।
সহীহ হাদীসের সজ্ঞা দিতে গিয়ে ইমাম নববী বলেছেন- “যে হাদীসের সনদ নির্ভযোগ্য ও সঠিক রূপে সংরক্ষণকারী বর্ণনা কারকদের সংযোজনে পরস্পরাপূর্ণ ও যাতে বিরল ও ত্রুটিযুক্ত বর্ণনাকারী একজনও নেই, তাই ‘হাদীসে সহীহ।’
হাসান: যে হাদীসের বর্ণনাকারীর মধ্যে সকল গুণ বর্তমান থাকা সত্ত্বেও যদি স্মরণ শক্তির কিছুটা দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়, তবে সেই হাদীসকে ‘হাদীসে হাসান’ বলে।
জয়ীফ: উপরিউক্ত হাদীসে সহীহ ও হাদীসে হাসানে বর্ণিত গুণগুলি যদি সনদ বর্ণনাকারী রাবীদের মধ্যে কম পরিলক্ষিত হয় তবে তাকে ‘হাদীসে জয়ীফ’ বলে।
[এখানে ভুল বুঝার অবকাশ আছে, এ জন্য তা থেকে মুক্ত করার মানসে হাদীসের ব্যাখ্যা মেশকাত শরীফ থেকে দেয়া হলো- রাবীর ‘জোফ’ বা দুর্বলতার কারণেই হাদীসটিকে জয়ীফ বলা হয়, অন্যথায় (নাউজুবিল্লাহ) রাসূলের কোন কথা জয়ীফ নয়। জয়ীফ হাদীসের জো’ফ কম ও বেশী হতে পারে। খুব কম হলে তা হাসানের নিকটবর্তী থাকে। আর বেশী হলে তা একেবারে মাওজুতে পরিণত হতে পারে। প্রথম পর্যায়ের জঈফ হাদীস আমলের ফজিলত বা আইনের উপকারিতায় ব্যবহার করা যেতে পারে, আইন প্রণয়নে নয়।]
রাবীদের সংখ্যার ভিত্তিতে হাদিসের প্রকারভেদ
হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে সকল ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীদের সংখ্যা এক রকম হয়নি। কখনো কম কখনো বা বেশী হয়েছে। এ জন্য এর ভিত্তিতে শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। যা দুই প্রকার। যথা:- ১. মুতাওয়াতির ২. আহাদ।
মুতাওয়াতির হাদিস কাকে বলে
যে হাদীসের সনদের বর্ণনাকারীদের সংখ্যা এত অধিক যে তাঁদের সম্পর্কে মিথ্যা হাদীস রচনার অভিযোগ আনা অসম্ভব বলে মনে হয়। এই ধরনের হাদীসকে ‘হাদীসে মুতাওয়াতির’ বলে।
মুসলিম শরীফে বলা হয়েছে – ‘যে কোন সহীহ হাদীসকে যুগে যুগে এত অধিক পরিমাণে লোকেরা বর্ণনা করছেন যে, একটি মিথ্যা কথার পক্ষে এত সংখ্যক লোক দলবদ্ধ হওয়াকে মানব বুদ্ধি অসম্ভব মনে করে, আবার সকলে এক অঞ্চলের লোক নন, বিভিন্ন অঞ্চল ও বিভিন্ন গোত্রের লোক। পরস্পরের মধ্যে তেমন যোগাযোগের কোন ব্যবস্থাই কোন কালে হয় নি। আবার রাবীগণের সংখ্যা সকল যুগে একই প্রকার রয়ে গেছে, কোন যুগে কমে এমন দাঁড়ায় নি যে সংখ্যাগুলি একত্র হওয়াকে মানব বুদ্ধি অসম্ভব ও অস্বাভাবিক মনে করে না। আর তাঁরা যে কথাটি সংবাদ স্বরূপ পৌঁছে, তা দৃষ্ট ও বাস্তব অনুভূতি পক্ষান্তরে তা কোন ধারনামূলক বস্তু.ও সম্ভাবনামূলক নয়। এমন হাদীসকে ‘খবরে মোতাওয়াতির’ বলে।
খবরে মোতাওয়াতির আবার দু’প্রকার ১. লজি ও ২. মানবি।
লজি : মোতাওয়াতির লজি ঐ হাদীসকে বলে যার শব্দ গুলিও যুগে যুগে একই প্রকারের রাবীগণ কর্তৃক আবৃত্তি হয়ে আসছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (স.) এর বাণীটি “সাতারাওনা রাব্বুকুম” অর্থাৎ নিশ্চয় তোমরা তোমাদের প্রভূকে দেখবে।
মা’নবি: মোতাওয়াতির মা’নবি ঐ সমস্ত হাদীসকে বলে, যে হাদীসে কোন একটি ঘটনাকে বহুলোক বিভিন্ন প্রকারে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এ ধরনের বিভিন্নতা সত্ত্বেও সকলকে একটি জায়গায় একমত হতে দেখা যায়। যেমন- কেউ বলেছেন, হাতেরম তায়ী একশত উট দান করেছেন, কেহ বলেন আশিটি উট দান করেছেন, কেউ বলেন নব্বই, কেউ বলেন সত্তরটি। এই ভাবে বিভিন্ন লোক বিভিন্ন সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। অতএব সংখ্যার দিকে তাকালে এই হাদীসটি খবরে মোতাওয়াতির হতে পারে না কিন্তু একটি কথায় সবাইকে একমত দেখা যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে হাতেমতায়ী দানশীল ছিলেন। তাই এ হাদীসকে ‘মোতাওয়াতির মা’নবি’ বলা হয়েছে।
আহাদ হাদিস কত প্রকার
এ ধরনের হাদীস আবার তিন প্রকার ১. গরীব ২. আজিজ ৩. মশহুর।
গরীব : কোন সহীহ হাদীসের যদি বর্ণনাকারী একজন হন তবে তাকে ‘গরীব’ হাদীস বলে।
আজিজ : কোন সহীহ হাদীসের বর্ণনাকারী যদি দু’জন হন বা তার থেকে কম না হন তাহলে ঐ প্রকার হাদীসকে ‘হাদীসে আজিজ’ বলে।
মশহুর: যে হাদীসের বর্ণনাকালী মাত্র তিনজন বা তার থেকে কম নয় এ ধরনের হাদীসকে ‘হাদীসে মশহুর’ বলে।
অগ্রহণযোগ্য হাদিস
এ ছাড়াও আরো তিন প্রকার হাদীস আছে, যথা- ১. মাওজু ২. মারূক ৩. মোহাম
মাওজু: যে হাদীসের রাবী জীবনের কোন সময় রাসূলুল্লাহর (স.) নামে ইচ্ছে করে কোন মিথ্যা কথা রচনা করেছেন বলে প্রমাণ আছে- তাঁর হাদীসকে ‘হাদীসে মাওজু’ বলে। এ ধরনের ব্যক্তির কোন হাদীসই কখনো গ্রহণযোগ্য নয়- যদি সে অতপর খালেস তওবাও করে।
মারূক: যে হাদীসের রাবী হাদীসের ব্যাপারে নয় বরং সাধারণ কাজকারবারে মিথ্যা কথা বলে খ্যাত হয়েছেন- তাঁর হাদীসকে হাদীসে মাতরূক বলে। এ ধরনের ব্যক্তির হাদীসও পরিত্যাজ্য। অবশ্য পরে যদি তিনি সত্যিকার অর্থে তওবা করেন এবং মিথ্যা পরিত্যাগ ও সত্য গ্রহণ করেন তা হলে তাঁর পরবর্তী কালের হাদীস গ্রহণ করা যেতে পারে।
মোহাম : অপরিচিত রাবী অর্থাৎ যাঁর স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়নি, যাতে তাঁর দোষগুণ বিচার করা যেতে পারে। তাঁর হাদীসকে ‘হাদীসে মোহাম’ বলে।এ ধরনের ব্যক্তি সাহাবী না হলে তাঁর হাদীস গ্রহণ করা যাবে না।
হাদীসে কুদসী
হাদীসের ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বের দাবীদার এই হাদীসে কুদসী। এ হাদীসের মূল বক্তব্য সরাসরি আল্লাহর তরফ থেকে প্রাপ্ত।
কুদসী পদটি আরবী ‘কুদুস’ থেকে আগত, যার অর্থ পবিত্ৰতা, মহানত্ম। সংজ্ঞা : যে হাদীসের মূল কথা সরাসরি আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে এসেছে সেই হাদীসকেই ‘হাদীসে কুদসী’ বলে। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নবীকে ‘ইলহাম’ কিংবা স্বপ্ন যোগে এই মূল কথাগুলি জানিয়ে দিয়েছেন 1 প্রখ্যাত হাদীস ব্যাখ্যাতা মুল্লা আলী আল-কারী ‘হাদীসে কুদসী’র সংজ্ঞা দান প্রসংগে বলেছেন- ‘হাদীসে কুদসী’ সে সব হাদীস যা শ্রেষ্ঠ বর্ণনাকারী পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল পরম নির্ভরযোগ্য হযরত মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর নিকট থেকে বর্ণনা করেন কখনো জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে জেনে কখনো সরাসরি অহী কিংবা ইলহাম বা স্বপ্ন যোগে লাভ করেন, যে কোন প্রকারের ভাষার সাহায্যে এটা প্রকাশ করার দায়িত্ব রাসূলের উপর অর্পিত হয়ে থাকে।” (হাদীস সংকলনের ইতিহাস পৃঃ ৩৩)
এ সম্বন্ধে আল্লামা বাকী তাঁর ‘কুল্লিয়াত’ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘কোরআনের শব্দ, ভাষা, অর্থ, ভাব ও কথা সবই আল্লাহর নিকট থেকে সুষ্পষ্ট ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ ; আর ‘হাদীসে কুদসীর’র শব্দ ও ভাষা রাসূলের; কিন্তু উহার অর্থ, ভাব ও কথা, আল্লাহর নিকট হতে ইলহাম কিংবা স্বপ্ন যোগ প্রাপ্ত।”
এবার নিশ্চয় বুঝতে পারা গেলো যে, হাদীসে কুদসী ও কোরআনের মধ্যে পার্থক্য কি? তবুও কিছু অস্পষ্টতা থেকে যাচ্ছে, ছকের সাহায্য নিলে মনে হয় আমাদের জন্যে বুঝতে সুবিধা হবে।
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্ব
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্ব এত যে সে কথা বলে শেষ করা যায় না।
এ প্রসংগে আল্লাহ নিজেই বলেছেন- “বল হে নবী, আল্লাহ ও রাসূলকে মেনে চল, যদি তা না কর তবে জেনে রাখ আল্লাহ কাফেরদের ভাল বাসেন না।” (সূরা আল ইমরান, ২২ আয়াত)
এই আয়াত থেকেই হাদীসের গুরুত্ব যে কত তা স্পষ্ট বুঝা যায় রাসূলকে (স.) মেনে চল এর অর্থ হলো নবী (স.) যা করেছেন, বলেছেন, অনুমোদন করেছেন তা মেনে চলা।
অন্য স্থানে একটু ব্যাপকভাবে বলা হয়েছে – “হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও রাসূলের (স.) আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্য হতে দায়িত্বশীল লোকদেরও অনুগত হও, কোন বিষয়ে তোমরা পরস্পর মতবিরোধ করলে তাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরাও।”
এই আয়াতে তিনটি বিভিন্ন সত্তার আনুগত্য করার কথা বলা হয়েছে- ১. আল্লাহর আনুগত্য ২. রাসূল (স.)-এর আনুগত্য ৩. মুসলিম দায়িত্বশীল লোকদের আনুগত্য করা। যেহেতু ইসলাম সর্বকালের সর্ব মানুষের জন্য, এই জন্য তৃতীয় স্তরে দায়িত্বশীলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
হাদীসের অপরিহার্যতা
এতক্ষণের আলোচনায় আমরা নিশ্চয় বুঝতে পারলাম হাদীসের গুরুত্ব কতটুকু। হাদীসের অপরিহার্যতা হলো এই যে হাদীস ছাড়া কোরআনের ব্যাখ্যা করা যায় না। তাছাড়া কোরআন ও হাদীস সম্পর্কে রাসূল (স.) নিজেই বলেছেন- “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। এই দুটি অনুসরণ করতে থাকলে অতঃপর তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও আমরা সূন্নাত (হাদীস) এবং কিয়ামতের দিন হাওযে কাওসার এ উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত এই দুটি জিনিস কখনই পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন হবে না।” (মুস্তাদরাক হাকেম ১ম খণ্ড ৯৩ পৃঃ)
বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে রাসূল (স.) বলেছেন- “দুটি জিনিস যা আমি তোমাদের মাঝে রেখে যাচ্ছি তোমরা যতক্ষণ এই দুটি জিনিস দৃঢ়ভাবে ধরে থাকবে তোমরা কখনও গোমরাহ হবে না। তা হলো, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত।” (মালেক ইবনে আনাস বর্ণিত- মুস্তাদরক হাকেম)
এবার নিশ্চয় বুঝতে বাকী থাকার কথা নয় কেন আজ সারা বিশ্বে মুসলমানদের এই দশা। আসলে আমরা কোরআন হাদীসের শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছি। এরপর, আমাদের দেশে এমনি এক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে যা ইংরেজ প্রবর্তিত। এতে কোরআন হাদীস শিক্ষার তেমন কোন সু ব্যবস্থা নেই। শুধু মাদ্রাসার ভাইয়েরা যা একটু আধটু জ্ঞান পেয়ে থাকেন। তাঁরাও আবার আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকেন। বলতে কুণ্ঠা নেই যে, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও এই জন্যই আমরা এতো নির্যাতিত। তাই আর বসে থাকলে চলবে না, নিজেদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে ইসলামী জ্ঞান অর্জনের জন্য।
শিরক শব্দের অর্থ কি? শিরক কত প্রকার? মুশরিক কাকে বলে?
কুফর শব্দের অর্থ কি? কুফর কত প্রকার ও কি কি? কাফের কাকে বলে?