বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে ইহরাম শব্দের অর্থ কি এবং ইহরাম বাধার নিয়ম, ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থান, ইহরামের সুন্নত, ইহরাম বাঁধার দোয়া, ইহরামের পর নিষিদ্ধ বিষয় সমূহ।
Table of Contents
Toggleইহরাম শব্দের অর্থ কি
ইহরাম বাঁধার মধ্য দিয়ে হজ ও উমরার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ইহরাম শব্দের আভিধানিক অর্থ নিষিদ্ধ করা। হজ ও উমরা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি যখন হজ বা উমরা কিংবা উভয়টি পালনের উদ্দেশ্যে নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করে, তখন তার ওপর কতিপয় হালাল ও জায়েয বস্তুও হারাম হয়ে যায়। এ কারণেই এ প্রক্রিয়াটিকে ইহরাম বলা হয়।
শুধু হজ বা উমরার সংকল্প করলেই কেউ মুহরিম হবে না। যদিও সে নিজ দেশ থেকে সফর শুরুর সময় হজের সংকল্প করে। তেমনি শুধু সুগন্ধি ত্যাগ অথবা তালবিয়া পাঠ আরম্ভ করলেই কেউ মুহরিম হবে না। এ জন্য বরং তাকে হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করার নিয়ত করতে হবে।
তাই হজ ও উমরা করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি গোসল ও পবিত্রতা অর্জন সম্পন্ন করে ইহরামের কাপড় পরিধান করবেন, অতঃপর
ইহরাম বাধার নিয়ম
বাংলাদেশী হাজীগণ সাধারণত তামাত্তু হজ্জ করে থাকেন। ঢাকা হতে জেদ্দা পৌঁছাতে বিমানে সাধারণত সাড়ে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগে। তামাত্তু হাজীগণ জেদ্দা অবতরণের অন্তত আধা ঘন্টা পূর্বে বিমানের দেওয়া মীকাত বরাবর পৌঁছানোর ঘোষণা ও সবুজ সংকেত দানের পরপরই ওযু শেষে ওমরাহর জন্য ইহরাম বাঁধবেন।
বাংলাদেশী হাজীগণ যদি মদীনা হয়ে মক্কায় যান, তাহলে মদীনায় নেমে যুল-হুলাইফা থেকে ইহরাম বাঁধবেন, তার আগে নয়। কেননা জেদ্দা হয়ে তিনি মদীনায় এসেছেন সাধারণ মুসাফির হিসাবে মসজিদে নববীতে সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে, হজ্জের উদ্দেশ্যে নয়। আর মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করা হজ্জের কোন অংশ নয়।
ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থান
ইহরাম বাঁধার নির্দিষ্ট স্থানকে শরিয়তের ভাষায় মিকাত বলা হয়। পাঁচটি স্থান থেকে ইহরাম বাঁধা যায়।
এক. জুল হুলায়ফা বা বীরে আলী: এটি মদিনাবাসী এবং মদিনা হয়ে মক্কায় প্রবেশকারীদের মিকাত।
দুই. ইয়ালামলাম: এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে জেদ্দা হয়ে মক্কা প্রবেশকারীদের মিকাত।
তিন. আল-জুহফা: এটি সিরিয়া, মিসর ও সেদিক থেকে আগতদের মিকাত।
চার. কারনুল মানাজিল বা আসসায়েল আল-কাবির: এটি নাজদ থেকে আগতদের জন্য মিকাত।
পাঁচ. যাতুল ইরক: এটি ইরাক থেকে আগতদের জন্য মিকাত।
ইহরামের সুন্নত
(১) ইহরামের পূর্বে অযু বা গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা উত্তম। তবে শর্ত নয়। মহিলাগণ নাপাক অবস্থায় ইহরাম বাঁধতে পারবেন।
(২) দেহে সুগন্ধি ব্যবহার করা, পোশাকে নয়।
(৩) পুরুষদের জন্য সাদা সেলাইবিহীন লুঙ্গী ও চাদর পরিধান করা। মহিলাদের জন্য যে কোন ধরনের শালীন পোষাক পরিধান করা, যা পুরুষদের পোশাকের সদৃশ নয়।
যে কোন ফরয সালাতের পর কিংবা ‘তাহিয়্যাতুল অজু’ দুই রাকাত নফল সালাতের পর ইহরাম বাঁধা চলে। তবে ইহরাম বাঁধার সাথে সালাতের কোন সম্পর্ক নেই।
শায়খ আবদুল্লাহ বিন জাসের, আহকামুল হজ্জ (রিয়াদ: ৩য় সংস্করণ ১৪১২/১৯৯২) পৃঃ ৭০-৭৫।
ইহরাম বাঁধার দোয়া
নিম্নোক্ত যে কোন একটি দোয়া পাঠের মাধ্যমে ইহরাম বাঁধতে হবে।
(১) লাব্বায়েক উমরাতান (আমি ওমরাহর জন্য হাজির)।
(২) লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা ওমরাতান। (হে আল্লাহ! আমি ওমরাহর জন্য হাজির)।
(৩) লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা ওমরাতাম মুতামাত্তিআন বিহা ইলাল হাজ্জি; ফাইয়াসসিরহা লি ওয়া তাক্বাব্বালহা মিন্নী (হে আল্লাহ! আমি ওমরাহর জন্য হাজির, হজের উদ্দেশ্যে উপকার লাভকারী হিসেবে। অতএব তুমি আমার জন্য ওমরাহকে সহজ করে দাও এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করে নাও)।
# যারা একই ইহরামে ওমরাহ ও হজ্জ দুটিই করবেন, তারা বলবেন, লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা ওমরাতান ওয়া হাজ্জান।
## যারা কেবলমাত্র হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধবেন, তারা বলবেন লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা হাজ্জান।
### কিন্তু যারা পথিমধ্যে অসুখের জন্য বা অন্য কোন কারণে হজ্জ আদায় করতে পারবেন না বলে আশঙ্কা করবেন, তারা ‘লাব্বায়েক উমরাতান’ অথবা ‘লাব্বায়েক হাজ্জান’ বলার পর শর্তাধীন দোয়া পড়বেন, ফাইন হাবাসানী হা-বিসুন, ফা মাহাল্লী হাইছু হাবাসতানী। অর্থ: যদি (আমার হজ্জ বা ওমরাহ পালনে) কোন কিছু বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে যেখানে তুমি আমাকে বাধা দিবে (হে আল্লাহ!), সেখানেই আমার হালাল হওয়ার স্থান হবে। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৭১১)।
#### যারা কারু পক্ষ থেকে বদলী হজ্জ করবেন, তারা তাদের মুওয়াক্কিল পুরুষ হলে মনে মনে তার নিয়ত করে বলবেন, লাব্বায়েক আন ফুলান (অমুকের পক্ষ হতে আমি হাজির)। আর মহিলা হলে বলবেন, লাব্বায়েক আন ফুলা-নাহ। যদি আন ফুলান বা ফুলা-নাহ বলতে ভুলে যান, তাতেও অসুবিধা নেই। নিয়তের উপরেই আমল কবুল হবে ইনশাআল্লাহ।
##### সঙ্গে নাবালক ছেলে বা মেয়ে থাকলে (তাদেরকে ওযু করিয়ে ইহরাম বাঁধিয়ে) তাদের পক্ষ থেকে তাদের অভিভাবক মনে মনে তাদের নিয়ত করে উপরোক্ত দোয়া পড়বেন। (ক্বাহত্বানী, পৃঃ ৫২-৫৫)।
ইহরামের পর নিষিদ্ধ বিষয় সমূহ
হজ্জ ও ওমরার ইহরাম সালাতে তাকবীরে তাহরীমার ন্যায়। ফলে ইহরাম বাধার পর মুহরিমের জন্য অনেকগুলি বিষয় নিষিদ্ধ থাকে। যেমন,
(১) সুগন্ধি ব্যবহার করা।
(২) স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের জন্যই মাথার চুল এবং যে কোন উপায়ে শরীরের যে কোন স্থানের পশম উঠানো ও হাত পায়ের নখ কাটা।
(৩) পশু-পক্ষী বা যেকোন প্রাণী শিকার করা। এমনকি শিকার ধরতে ইশারা-ইঙ্গিতে সহযোগিতা করা। তবে ক্ষতিকর জীবজন্তু যেমন সাপ, বিচ্ছু, ইদুর, ক্ষ্যাপা কুকুর, মশা, উকুন ইত্যাদি মারার অনুমতি রয়েছে। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৯৮-৯৯)।
(৪) যাবতীয় যৌনাচার, বিবাহের প্রস্তাব, বিবাহের আকদ বা যৌন আলোচনা করা।
(৫) পুরুষের জন্য পাগড়ি, টুপী ও রুমাল ব্যবহার করা। তবে প্রচণ্ড গরমে ছায়ার জন্য বা বৃষ্টিতে ছাতা বা ঐরূপ কিছু ব্যবহার করায় দোষ নেই।
(৬) পুরুষের জন্য কোন প্রকার সেলাই করা কাপড় যেমন জুব্বা, পাঞ্জাবী, শার্ট, গেঞ্জি, মোজা ইত্যাদি পরিধান করা। তবে তালি লাগানো ইহরামের কাপড় পরায় দোষ নেই।
(৭) মহিলাদের জন্য মুখাচ্ছাদন ও হাত মোজা ব্যবহার করা। তবে পরপুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখা ওয়াজিব।
(৮) ঝগড়া-বিবাদ করা এবং শরীআত বিরোধী কোন বাজে কথা বলা ও বাজে কাজ করা।
উপরোক্ত কাজগুলির মধ্যে কেবল যৌন মিলনের ফলে ইহরাম বাতিল হবে। বাকি গুলোর জন্য ইহরাম বাতিল হবে না। তবে ফিদিয়া ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ কাফফারা স্বরূপ একটি বকরী কুরবানী দিবেন অথবা ৬ জন মিসকীনকে তিন ছা খাদ্য দিবেন অথবা তিন দিন সিয়াম পালন করবেন।
মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৮৮।
অবশ্য যদি ভুলে কিংবা অজ্ঞতাবশত কিংবা বাধ্যগত কারণে অথবা ঘুম অবস্থায় কেউ করে ফেলে, তাতে কোন গুনাহ নেই বা ফিদিয়া নেই।
উপরোক্ত নিষিদ্ধ বিষয় সমূহের উদ্দেশ্য হল মুহরিমকে দুনিয়াবি সাজসজ্জা থেকে মুক্ত হয়ে পুরোপুরি আল্লাহ মুখী করা। পুরুষের জন্য সেলাই বিহীন কাপড় পরিধানের উদ্দেশ্য হল সকল জৌলুস ও প্রদর্শনী থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর জন্য খালেছ ও নিবেদিতপ্রাণ হওয়া।
ইহরাম বাধার পর থেকে মসজিদুল হারামে পৌঁছা পর্যন্ত ইহরামের কারণে নিষিদ্ধ বস্তু সমূহ হতে বিরত থাকবেন এবং হালাল হওয়ার আগ পর্যন্ত সর্বদা সরবে নিম্নোক্ত দোয়া পড়বেন, যাকে ‘তালবিয়া’ বলা হয়। পুরুষগণ সরবে ও মহিলাগণ নিম্নস্বরে ‘তালবিয়া’ পাঠ করবেন।
মুয়াত্তা, তিরমিযী প্রভৃতি, মিশকাত হা/২৫৪৯।