জিলহজ্জ মাসের ফজিলত ও আমল. জিলহজ্জ মাসের রোজা কয়টি?

জিলহজ্জ-মাসের-ফজিলত-ও-আমল.-জিলহজ্জ-মাসের-রোজা-কয়টি

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে জিলহজ্জ মাসের ফজিলত ও আমল এবং জিলহজ্জ মাসের রোজা কয়টি।

জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের ফজিলত

ইসলামে যতগুলো মর্যাদাবান ও ফজিলত পূর্ণ দিবস রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন। এর মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে অনেক বাণী রয়েছে। এ সংক্রান্ত কতিপয় আয়াত ও হাদিস নিম্নে উল্লেখ করা হল—

(১) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে এ দিবসগুলোর রাত্রি সমূহের শপথ করেছেন। আমরা জানি আল্লাহ তাআলা যখন কোন বিষয়ের শপথ করেন তখন তা তার গুরুত্ব ও মর্যাদার প্রমাণ বহন করে । তিনি ইরশাদ করেন—

শপথ ফজরের ও দশ রাতের।

সূরা ফজর : ১-২

সাহাবী ইবনে আব্বাস রা., ইবনে যুবাইর ও মুজাহিদ রহ. সহ আরো অনেক মুফাসসিরে কেরাম বলেছেন যে, দশ রাত বলতে এ আয়াতে জিলহজ মাসের প্রথম দশ রাতের কথা বলা হয়েছে। ইবনে কাসীর রহ. বলেছেন—এ মতটি বিশুদ্ধ। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)।

নবী করিম স. থেকে এ দশ রাতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে কোন বাণী পাওয়া যায় না।

(২) রাসুলুল্লাহ স. বলেছেন: যিলহজের প্রথম দশ দিন হল দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিন। এ প্রসঙ্গে বহু হাদিস এসেছে। যার কয়েকটি তুলে ধরা হল—

সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনে নেক আমল করার মত আল্লাহর নিকট প্রিয় আর কোন আমল নেই। তারা প্রশ্ন করলেন হে আল্লাহর রাসূল ! আল্লাহর পথে জিহাদ করা কি তার চেয়ে প্রিয় নয়?

রাসূলুল্লাহ স. বললেন : না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে ঐ ব্যক্তির কথা আলাদা যে তার প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদে বের হয়ে গেল অতঃপর তার প্রাণ ও সম্পদের কিছুই ফিরে এল না।

বুখারী- ৯৬৯, তিরমিজি- ৭৫৭

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত নবী করীম স. বলেছেন : এ দশ দিনে (নেক) আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবীর (আল্লাহু আকবার) তাহমিদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি করে পাঠ কর।

আহমদ-১৩২, হাদিসটি সহিহ

যিলহজের প্রথম দশ দিনের চাইতে উত্তম কোন দিন নেই। বর্ণনাকারী বলেন, জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল ! এ দশ দিন (আমলে সালেহ) উত্তম, না আল্লাহর পথে জিহাদের প্রস্তুতি উত্তম? তিনি বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদের প্রস্তুতির চেয়ে তা (আমল) উত্তম।

ইবনে হিব্বান : ৩৮৫৩

এ তিন হাদিসের অর্থ হল—বছরে যতগুলো পবিত্র দিন আছে তার মাঝে এ দশ দিনের প্রতিটি দিন হল সর্বোত্তম। যেমন এ দশ দিনের অন্তর্গত কোন জুমআর দিন অন্য সময়ের জুমার দিন থেকে উত্তম বলে বিবেচিত।

(৩) আল্লাহর রাসূল স. এ দিনসমূহে নেক আমল করার জন্য তার উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। তার এ উৎসাহ এ সময়ের ফজিলত প্রমাণ করে।
(৪) নবী কারীম স. এ দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলীল ও তাকবীর পাঠ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আলোচিত হয়েছে উপরে ইবনে আব্বাসের হাদিসে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন—

যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিন সমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।

সূরা হজ্জঃ ২৮

এ আয়াতে নির্দিষ্ট ‘দিন সমূহ’ বলতে কোন দিনগুলোকে বুঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে ইমাম বুখারী রহ. বলেন—

ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন : ‘নির্দিষ্ট দিন সমূহ দ্বারা যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনকে বোঝানো হয়েছে।

সহীহ আল-বুখারী, ঈদ অধ্যায়

(৫) জিলহজ মাসের প্রথম দশকে রয়েছে আরাফা ও কোরবানির দিন। আর এ দুটো দিনের রয়েছে অনেক বড় মর্যাদা। যেমন হাদিসে এসেছে—

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. বলেন : আরাফার দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দার নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন—তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দাগণ আমার কাছে কি চায় ?

মুসলিম-১৩৪৮

আরাফাহ (জিলহজ মাসের নবম তারিখ) দিনটি ক্ষমা ও মুক্তির দিন। এ দিনে সাওম পালন করলে তা দুই বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গণ্য হয়। যেমন হাদিসে এসেছে—

সাহাবী আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ স. বলেন : আরাফার দিনের সাওম আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করেন।

মুসলিম-১৬৬২

তবে আরাফার এ দিনে আরাফাতের ময়দানে অবস্থানকারী হাজীগণ সওম পালন করবে না। কোরবানির দিনের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে :

সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে কুর্ত রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে উত্তম দিন হল কোরবানির দিন তারপর কোরবানি পরবর্তী মিনায় অবস্থানের দিনগুলো।

আবু দাউদ-১৭৬৫, হাদিসটি সহিহ

(৬) জিলহজ মাসের প্রথম দশকের এ দিনগুলো এমন মর্যাদাসম্পন্ন যে, এ দিনগুলোতে সালাত, সাওম, সদকা, হজ ও কোরবানি আদায় করা হয়ে থাকে। অন্য কোন দিন এমন পাওয়া যায় না যাতে এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ নেক আমল একত্রিত হয়।

একটি জিজ্ঞাসা : রমজানের শেষ দশক অধিক ফজিলতপূর্ণ না কি জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন বেশি ফজিলত সম্পন্ন?

জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিবস অধিক ফজিলতপূর্ণ—এ ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই। করণ, এ বিষয়ে অসংখ্য দলিল-প্রমাণ রয়েছে। তবে মতভেদের অবকাশ রয়েছে রাত্রির ফজিলত নিয়ে। অর্থাৎ, রমজানের শেষ দশকের রাত বেশি ফজিলতপূর্ণ না যিলহজের প্রথম দশকের রাতসমূহ বেশি ফজিলতের অধিকারী ?

বিশুদ্ধতম মত হল, রাত হিসেবে রমজানের শেষ দশকের রাতগুলো ফজিলতের দিক দিয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী। আর দিবসের ক্ষেত্রে জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিবস অধিক মর্যাদার অধিকারী।

ইবনে রজব রহ. বলেন : যখন রাত্রি উল্লেখ করা হয় তখন দিবস গুলো তার মাঝে গণ্য করা হয়। এমনিভাবে, যখন দিবস উল্লেখ করা হয় তখন তার রাত্রিগুলো তার মাঝে গণ্য হয়—এটাই নিয়ম। এ ক্ষেত্রে শেষ যুগের উলামায়ে কেরাম যা বলেছেন সেটাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতে পারে। তাহলো, সামগ্রিক বিচারে জিলহজ মাসের প্রথম দশকের দিবসগুলো রমজানের শেষ দশকের দিবস সমূহের চেয়ে অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন। আর রমজানের শেষ দশকের লাইলাতুল কদর হল সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন।

ইবনুল কায়্যিম রহ. এ ক্ষেত্রে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন : রমজানের শেষ দশকের রাতগুলো সবচেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ। কারণ, তাতে লাইলাতুল কদর রয়েছে। অপরদিকে, জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের দিবস সমূহ অধিকতর ফজিলতপূর্ণ, কারণ এ দিনগুলোতে তারবিয়াহ-এর দিন, আরাফার দিন, কোরবানির দিন রয়েছে।

যাদুল মাআদ: ইবনুল কায়্যিম

জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের আমল

খাঁটি মনে তওবা করা

তওবার অর্থ প্রত্যাবর্তন বা ফিরে যাওয়া। যে সকল কথা ও কাজ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অপছন্দ করেন তা থেকে যে সকল কথা ও কাজ আল্লাহ পছন্দ করেন তাঁর দিকে ফিরে যাওয়ার নাম তওবা—হোক এ সকল কাজ প্রকাশ্যে বা গোপনে। সাথে সাথে অতীতের এ ধরনের কাজ থেকে অনুতপ্ত হতে হবে, কাজগুলো ত্যাগ করতে হবে ও দৃঢ় সংকল্প করতে হবে যে ঐ ধরনের কাজ আর কোন দিন করব না। আরো সংকল্প করতে হবে যে, আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় কাজ যেমন আদায় করব তেমনি তার নিষিদ্ধ কাজগুলো পরিহার করব।

যখনই কোন পাপ কাজ সংঘটিত হবে তখন সাথে সাথে তা থেকে তওবা করা একজন মুসলিমের জন্য ওয়াজিব। কেননা, তার জানা নেই কখন তার মৃত্যু হবে আর কতক্ষণ সে বেঁচে থাকবে। মনে রাখতে হবে, একটি পাপ বা গুনাহ অন্য আরেকটি গুনাহের দ্বার খুলে দেয়। তওবা না করলে এমনিভাবে গুনাহের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর সময়ের মর্যাদা হিসেবে গুনাহের শাস্তি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। অধিক মর্যাদাসম্পন্ন বা ফজিলতপূর্ণ সময়ে গুনাহের কাজের শাস্তি বেশি হয়। প্রথমত গুনাহের শাস্তি দ্বিতীয়ত ফজিলত পূর্ণ সময়ের অবমাননা ও অবমূল্যায়ন করার শাস্তি।

ইমাম নববী রহ. বলেন : মুসলিম ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হল সকল ধরনের গুনাহ থেকে তওবা করা যা সে করেছে। যদি কোন এক ধরনের গুনাহ থেকে তওবা করে তাহলেও তার তওবা সঠিক হবে। তবে অন্য গুনাহের তওবা তার দায়িত্বে থেকে যাবে। কোরআনের বহু আয়াত, একাধিক হাদিস ও ইজমায়ে উম্মাহ তওবা ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ বহন করে।

নুজহাতুল মুত্তাকিন শারহু রিয়াদুস সালেহীন

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন :

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর—বিশুদ্ধ তওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সে দিন আল্লাহ লজ্জা দেবেন না নবীকে এবং তার মোমিন সঙ্গীদেরকে, তাদের জ্যোতি তাদের সম্মুখে ও দক্ষিণ পার্শ্বে ধাবিত হবে। তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জ্যোতিকে পূর্ণতা দান কর এবং আমাদেরকে ক্ষমা কর, নিশ্চয় তুমি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান ।

সূরা তাহরীম : ৮

ইবনে কায়্যিম রহ. বলেন : খাঁটি তওবা (তওবা নাছুহা) হল তিনটি বিষয়ের সমষ্টির নাম।

প্রথম : সকল প্রকার গুনাহ থেকে তওবা করা। এমন যেন না হয় কয়েকটি গুনাহ থেকে তওবা করলাম, দু একটি রেখে দিলাম এ ভেবে যে এ থেকে আরো কয়েকদিন পর তওবা করব। এমন করলেও তওবা হবে, তবে তা তওবা নাসূহা হিসেবে গৃহীত হবে না—যে তওবা করতে আল্লাহ তাআলা উপরোক্ত আয়াতে কারীমায় নির্দেশ দিয়েছেন।

দ্বিতীয় : সম্পূর্ণভাবে পাপ পরিত্যাগ করার জন্য সততার সাথে দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। এমন যেন না হয় যে তওবা করলাম আর মনে মনে বললাম জানি না, আমি এ তাওবার উপর অটল থাকতে পারব কি-না ।

তৃতীয় : তওবা খালেছ ভাবে আল্লাহকে ভয় করে ও তার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষেই করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকবে না।

অবশ্যই এ তওবার সাথে আল্লাহ তাআলার কাছে অব্যাহতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা ও সকল গুনাহ বা পাপ নিজের থেকে মিটিয়ে দিতে হবে। তা হলেই কামেল তওবা বলে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

হজ ও ওমরাহ আদায় করা

হজ হল ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

মানুষের মাঝে যাদের সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহের হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য। এবং কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সে জেনে রাখুক নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন।

সূরা আলে ইমরান : ৯৭

হাদিসে এসেছে—

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত যে নবী কারীম স. বলেছেন : পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। এ কথার ঘোষণা দেয়া যে আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ স. আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করা, জাকাত আদায় করা, হজ করা, রমজানে সিয়াম পালন করা।

বুখারী- ৮ মুসলিম – ১৬

অতএব হজ হল সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর ফরজ। তবে ওমরাহ করার হুকুম কি? তা কি ওয়াজিব না সুন্নত ? এ বিষয়ে দুটি মত রয়েছে। বিশুদ্ধ মত হল ওমরাহ করা ওয়াজিব। যেমন হাদিসে এসেছে :

ইসলাম হল এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোন মাবুদ নেই ও মোহাম্মদ স. আল্লাহর রাসূল । সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, হজ ও ওমরাহ আদায় করবে এবং জানাবাতের (সহবাস, স্বপ্নদোষ, বীর্যপাত ইত্যাদির) পর গোসল করবে, পরিপূর্ণরূপে অজু করবে ও সিয়াম পালন করবে।

ইবনে খুযাইমা, হাদিসটি মুসলিমের শর্তে সহীহ

এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ওমরাহ পালন করা ওয়াজিব। হাদিসে আরো এসেছে—

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ স.-কে জিজ্ঞেস করলাম মেয়েদের জন্য কি জিহাদের নির্দেশ রয়েছে ? তিনি বললেন হ্যাঁ, তাদের দায়িত্বে এমন জিহাদ রয়েছে যাতে লড়াই-যুদ্ধ নেই। তা হল হজ ও ওমরাহ।

ইবনে মাজাহ- ৩৯১০, হাদিসটি সহিহ

এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে মেয়েদের জন্য ওমরাহ ওয়াজিব। যখন মেয়েদের জন্য ওমরাহ ওয়াজিব হল তখন পুরুষদের জন্য তো অবশ্যই।

হজ জীবনে একবার করা ফরজ। হাদিসে এসেছে :—

ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত সাহাবী আকরা ইবনে হাবিস রা. রাসূলে কারীম স.-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল! হজ কি প্রতি বছর না মাত্র একবার ? তিনি বললেন : হজ মাত্র একবার করা ফরজ। সুতরাং যে একাধিক হজ করল তা নফল হিসেবে গৃহীত।

আবু দাউদ-১৭২১, হাদিসটি সহিহ

নবী করিম স. এ দুটি মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের জন্য উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। এ দুটি এবাদতে রয়েছে পাপের কুফল থেকে আত্মার পবিত্রতা, যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও সম্মানিত হতে পারে। তাই নবী কারীম স. বলেছেন :—

যে ব্যক্তি হজ করেছে, তাতে কোন অশ্লীল আচরণ করেনি ও কোন পাপে লিপ্ত হয়নি সে যেন সেই দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে গেল যে দিন তার মাতা তাকে প্রসব করেছে।

বুখারী -১৪৪৯, মুসলিম- ১৩৫০

হাদিসে আরো এসেছে—

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে নবী কারীম স. বলেছেন :— এক ওমরাহ থেকে অন্য ওমরাহকে তার মধ্যবর্তী পাপ সমূহের কাফ্ফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয় । আর কলুষমুক্ত হজের পুরস্কার হল জান্নাত।

বুখারী, নং ১৬৮৩, মুসলিম, নং ১৩৪৯

হজ মাবরুর বা কলুষমুক্ত হজ বলা হয় এমন হজকে যার আহকাম সমূহ পূর্ণভাবে আদায় করা হয়েছে ও হজের সময় কোন পাপ ও অশ্লীল কাজ করা হয়নি এবং হজের সময়টা ছিল নেক আমল, কল্যাণমূলক কাজে ভরপুর।

ফাতহুল বারী : ইবনে হাজার

একজন মুসলিমের জন্য কর্তব্য হল অতি সত্বর পবিত্র হজ আদায় করে নেয়া। কেননা রাসূলে কারীম স. বলেছেন :—

যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছে করল সে যেন তা তাড়াতাড়ি আদায় করে নেয়। হতে পারে তাকে কোন রোগে আক্রান্ত করবে বা বাহন হারিয়ে যাবে অথবা কোন প্রয়োজন দেখা দেবে যা তার হজ আদায়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

ইবনে মাজাহ- ২৮৮৩, আহমদ-৩৫৫, হাদিসটি সহিহ

যে একবার ফরজ হজ ও ওমরাহ আদায় করেছে তার জন্য বার বার তা আদায় করা মুস্তাহাব। কেননা এ দুটি এবাদতে রয়েছে মহাপুরস্কার ও সওয়াব। রাসূলে কারীম স. বলেছেন :—

তোমরা হজ ও ওমরাহ বার বার আদায়ের চেষ্টা কর। কেননা এ দুটো ইবাদত দারিদ্রতাকে দূর করে যেমন আগুন লোহা ও স্বর্ণ-রুপার মরিচা দূর করে দেয়।

আহমদ- ৩২৩, তিরমিজি- ৮১০, নাসায়ী-২৪৬৭, ইবনে মাজাহ- ২৮৮৩, হাদিসটি সহিহ

নিয়মিত ফরজ ও ওয়াজিব সমূহ আদায়ে যত্নবান হওয়া

অর্থাৎ ফরজ ও ওয়াজিব সমূহ সময়-মত সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে আদায় করা। যেভাবে আদায় করেছেন প্রিয় নবী স.। সকল ইবাদত সমূহ তার সুন্নত, মুস্তাহাব ও আদব সহকারে আদায় করা। হাদিসে এসেছে—

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তি আমার কোন অলির সঙ্গে শত্রুতা রাখে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার বান্দা ফরজ ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারাই সর্বদা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয়পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে।

সে আমার কাছে কোন কিছু চাইলে আমি অবশ্যই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায় আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দেই। আমি যে কোন কাজ করতে চাইলে তাতে কোন রকম দ্বিধা-সংকোচ করি না, যতটা দ্বিধা-সংকোচ করি মোমিন বান্দার প্রাণ হরণে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে থাকে অথচ আমি তার বেঁচে থাকাকে অপছন্দ করি।

বুখারী-৬৫০২

এ হাদিসে কুদসীতে অনেকগুলো বিষয় আলোচিত হয়েছে। এর মাঝে একটি হল, ফরজ এবাদত সমূহ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আর নফল (যা ফরজ নয়) ইবাদত আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। যদি ফরজ ও নফল ইবাদাতসমূহ যত্ন সহকারে যথাযথ নিয়মে আদায় করা যায় তবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের এমন নৈকট্য অর্জন করা যাবে যা তিনি এ হাদিসে উল্লেখ করেছেন। আমরা তার ইবাদতে কিভাবে যত্নবান হতে পারি এ সম্পর্কে এ হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেন : ফরজসমূহ যত্নের সাথে আদায় করার অর্থ হল : আল্লাহর নির্দেশ পালন করা, তার নির্দেশকে সম্মান করা, মর্যাদা দেয়া, নির্দেশের সামনে শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত করা, আল্লাহর রবুবিয়াতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তার দাসত্বকে মনে প্রাণে মেনে নেয়া। আমল গুলো এভাবে যত্ন সহকারে আদায় করতে পারলে আল্লাহর সেই নৈকট্য অর্জন করা যাবে যা তিনি এ হাদিসে বলেছেন।

ফরজ-ওয়াজিব সমূহ যত্ন সহকারে নিয়ম মাফিক আদায় করা এমন একটি গুণ যার প্রশংসা আল্লাহ তাআলা তার কালামে পাকে করেছেন। বলেছেন—

এবং যারা নিজেদের সালাতে যত্নবান।

সূরা মাআরিজ : ৩৪

তাই আসুন ! আমরা এ পবিত্র দিনগুলোতে আল্লাহর ভালোবাসা ও নৈকট্য লাভের কর্মসূচী বাস্তবায়নের অনুশীলন করে অধিক সওয়াব ও প্রতিদান লাভ করতে চেষ্টা করি।

বেশি করে নেক আমল করা

নেক আমল সকল স্থানে ও সর্বদাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রিয়। তবে এই বরকতময় দিনগুলোতে নেক আমলের মর্যাদা ও সাওয়াব অনেক বেশি।

যারা এ দিনগুলোতে হজ আদায়ের সুযোগ পেলেন তারা তো ভাগ্যবান— সন্দেহ নেই। আর যারা হজে যেতে পারেনি তাদের উচিত হবে এ বরকতময় দিনগুলোকে মর্যাদা দিয়ে বেশি বেশি করে সালাত আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আযকার, দোয়া-প্রার্থনা, দান-সদকা, মাতা-পিতার সাথে সুন্দর আচরণ, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক গভীর করা, সৎকাজের আদেশ এবং অন্যায় ও অসৎ কাজের নিষেধ করাসহ প্রভৃতি ভাল কাজ সম্পাদন করা। যেমন ইতিপূর্বে হাদিসে আলোচিত হয়েছে যে বেশি বেশি করে নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ মহব্বত অর্জন করা যায়।

আল্লাহ তাআলার জিকির করা

এ দিন সমূহে অন্যান্য আমলের মাঝে জিকিরের এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, যেমন হাদিসে এসেছে : —

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম স. বলেছেন : এ দশ দিনে (নেক) আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবীর (আল্লাহু আকবার) তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি করে আদায় কর।

আহমদ-১৩২, হাদিসটি সহিহ

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :—

যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিন সমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।

সূরা হজ্জঃ ২৮

অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম বলেছেন : এ আয়াতে নির্দিষ্ট দিন বলতে যিলহজের প্রথম দশ দিনকে নির্দেশ করা হয়েছে। এ সময়ে আল্লাহর বান্দাগণ বেশি বেশি করে আল্লাহর প্রশংসা করেন, তার পবিত্রতা বর্ণনা করেন, তার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেন, কোরবানির পশু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম ও তাকবীর উচ্চারণ করে থাকেন।

উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করা

এ দিনগুলো সহ ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহত্ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। এ তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদ, বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, বাজার সহ সর্বত্র পাঠ করা হবে। তবে মেয়েরা নিম্ন-স্বরে পাঠ করবে। তাকবীর হল :

لله أكبر الله أكبر لا إله إلا الله، والله أكبر الله أكبر ولله الحمد

আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।

যিলহজ মাসের এ তাকবীরের ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম বলেন : এ তাকবীর আদায়ের পদ্ধতি সাধারণত দু প্রকার।

(এক) আত-তাকবীরুল মুতলাক বা যে তাকবীর সর্বদা পাঠ করা যেতে পারে

এ তাকবীর যিলহজ মাসের শুরু থেকে ১৩ ই যিলহজ পর্যন্ত দিন রাতের যে কোন সময় পাঠ করা যেতে পারে।

আজকে আমাদের সমাজে এ সুন্নতটি পরিত্যাজ্য হয়েছে বলে মনে করা হয়। এর আমল দেখা যায় না। তাই আমাদের উচিত হবে এ সুন্নত এর প্রচলন করা। এতে তাকবীর বলার সওয়াব অর্জন হবে ও সাথে সাথে একটি মিটে যাওয়া সুন্নত জীবিত করার সওয়াব পাওয়া যাবে। হাদিসে এসেছে :—

রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : আমার ইন্তেকালের পরে যে সুন্নত এর মৃত্যু হয়েছে তা যে জীবিত করবে সে ব্যক্তি এ সুন্নত আমলকারীদের সওয়াবের পরিমাণ সওয়াব পাবে এবং তাতে আমলকারীদের সওয়াবে কোন অংশে কম হবে না।

তিরমিজি-৬৭৭ ও ইবনে মাজাহ- ২০৯, হাদিসটি সহিহ

সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও আবু হুরাইরা রা. জিলহজ মাসের প্রথম দশকে বাজারে যেতেন ও তাকবীর পাঠ করতেন, লোকজনও তাদের অনুসরণ করে তাকবীর পাঠ করতেন।

বুখারী, ঈদ অধ্যায়

অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল স.-এর এই দুই প্রিয় সাহাবী লোকজনকে তাকবীর পাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।

মনে রাখতে হবে উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। কিন্তু সকলে একই আওয়াজে জামাতের সাথে তাকবীর পাঠ করবে না। কারণ এটা বেদআত। যেমন একজন বলল : ‘আল্লাহু আকবার’। সকলে বলল : ‘আল্লাহু আকবার’। কেননা, রাসূলুল্লাহ স. বা সাহাবায়ে কেরাম কখনো এরূপ করেননি। তবে সকলে একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন আওয়াজে তাকবীর পাঠ করতে পারবেন। তবে কাউকে তাকবীর শেখানোর জন্য এ রূপ করা হলে তার কথা আলাদা।

সতর্ক থাকতে হবে যে, আমরা কোন সুন্নত আদায় করতে যেয়ে যেন বিদআতে লিপ্ত হয়ে না পড়ি। আল্লাহর রাসূল স. ও তার সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে সুন্নত সমূহ আদায় করেছেন আমাদের তেমনই করতে হবে। এটাই হল আল্লাহর রাসূলের যথার্থ অনুসরণ। আমরা যদি সে সুন্নত আদায় করতে গিয়ে সামান্যতম ভিন্ন পদ্ধতি চালু করি তাহলে তা বিদআত বলে গণ্য হবে। হাদিসে এসেছে—

রাসূলে কারীম স. বলেছেন : যে ব্যক্তি এমন কাজ করল যার প্রতি আমাদের (ইসলামের) নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত।

বুখারী-২৬৯৮, মুসলিম- ১৭১৮

(দুই) আত-তাকবীরুল মুকাইয়াদ বা বিশেষ সময়ের তাকবীর

সেটা হল ঐ তাকবীর যা সালাতের পরে আদায় করা হয়ে থাকে। এ দ্বিতীয় প্রকার তাকবীর যা সালাতের পরে পাঠ করা হয়ে থাকে তা যিলহজ মাসের নবম তারিখ থেকে মিনার শেষ দিন অর্থাৎ ১৩ তারিখ পর্যন্ত পাঠ করতে হয়।

সিয়াম পালন করা

হাফসা রা. থেকে বর্ণিত যে নবী কারীম স. কখনো চারটি আমল পরিত্যাগ করেননি। সেগুলো হল : আশুরার সওম, জিলহজ্জের দশ দিনের সওম, প্রত্যেক মাসের তিন দিনের সওম, ও যোহরের পূর্বের দুই রাকাত সালাত।

আহমদ -২৮৭/৬, সহিহ সুনানে আবু দাউদ-২১০৬, সহীহ সুনানে নাসায়ী- ২২৩৬

এ হাদিসে জিলহজ্জের দশ দিনের সওম বলতে নবম তারিখ ও তার পূর্বের সাওম বুঝানো হয়েছে। কেননা দশম দিন অর্থাৎ ঈদের দিনে তো রোজা রাখা জায়েজ নেই । ইমাম নববী রহ. বলেন : নবম তারিখে সাওম পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব আমল। অপরদিকে আয়েশা রা.-এর একটি উক্তি রয়েছে যে, তিনি বলেছেন : আমি রাসূলুল্লাহ স.-কে যিলহজের দশ দিনে সওম পালন করতে দেখিনি।

এ উক্তি সম্পর্কে ইমাম নববী রহ. বলেন যে, আয়েশা রা. এর এ উক্তিটির ব্যাখ্যা রয়েছে। ব্যাখ্যা এই যে, রাসূলুল্লাহ স. কোন অসুবিধার কারণে সাওম পালন করেননি অথবা তিনি সওম পালন করেছিলেন কিন্তু আয়েশা রা. তা দেখেননি।

আয়েশা রা.-এর বক্তব্য দ্বারা যিলহজের প্রথম নয় দিনে সওম পালন না-জায়েজ হওয়ার কোন অবকাশ নেই। কারণ পূর্বে আলোচিত হাফসা রা.-এর হাদিসটি মুসবিত তথা একটি আমলকে প্রতিষ্ঠিত করে। আর আয়েশা রা.-এর বক্তব্যটি একটি আমলকে নাফি (নিষেধ) করে। হাদিসশাস্ত্রের মূলনীতি অনুযায়ী যা মুসবিত আমল প্রমাণ করে) তা নাফির উপর প্রাধান্য লাভ করে। এ নিয়মানুযায়ী আমলের জন্য হাফসা রা.-এর হাদীস গ্রহণ করা হবে।

অপরদিকে রাসূলে কারীম স. এ দশ দিনে সকল প্রকার নেক আমল করতে উৎসাহিত করেছেন আর সওম অবশ্যই নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত। বরং নেক আমল সমূহের মাঝে সওম একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট মর্যাদাসম্পন্ন একটি আমল। হাদিসে এসেছে—

সাহাবী আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম : হে রাসূলুল্লাহ স. আমাকে এমন একটি আমলের নির্দেশ দিন যা শুধু আমি আপনার থেকে পাওয়ার অধিকারী হব। আল্লাহর রাসূল স. বললেন : তুমি সওম (রোজা) পালন করবে। আর এর কোন নজির নেই ।

হাকেম ও সহীহ সুনানে নাসায়ী-২১০০

তবে নাসাঈ এর আরেকটি বর্ণনায় এসেছে যে আবু উমামা রা. বললেন : আমাকে একটি আমল সম্পর্কে নির্দেশ দিন। তিনি বললেন : সাওম পালন কর। এর সমকক্ষ কোন আমল নেই। তিনি আবারও বললেন : আমাকে একটি আমল সম্পর্কে নির্দেশ দিন আর রাসূল স. একই উত্তর দিলেন।

এ হাদিস দ্বারা সওম যে এক বড় মর্যাদাসম্পন্ন ও আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল তা আমরা অনুধাবন করতে পারি।

কোন কোন দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের মাঝে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, জিলহজ মাসের সাত, আট ও নয় তারিখে সাওম পালন করা সুন্নত। কিন্তু সওমের জন্য এ তিন দিনকে নির্দিষ্ট করার কোন প্রমাণ বা ভিত্তি নেই। জিলহজ্জের ১ থেকে ৯ তারিখে যে কোন দিন বা পূর্ণ নয় দিন সাওম পালন করা যেতে পারে। তবে আরাফার দিন অর্থাৎ জিলহজ মাসের নবম তারিখ সাওম পালনের ব্যাপারে স্বতন্ত্র নির্দেশনা রয়েছে।

বিশেষত আরাফার দিন সিয়াম পালন করা

সাহাবী আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ স. বলেন : আরাফার দিনের সওম আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।

মুসলিম-১১৬৩

তবে জিলহজ মাসের নবম তারিখে সওম পালন করবেন তারা যারা হজ পালনে রত নন। যারা এ দিনে হজ পালনে ব্যস্ত তাদের সওম পালন করা জায়েজ নয়। কেননা হাদীসে এসেছে :—

ইমাম আহমদ ইকরামা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন : আমি আবু হুরাইরা রা.-এর সাথে তার বাড়িতে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞেস করলাম আরাফার দিন (জিলহজের নবম তারিখে) আরাফাতের ময়দানে অবস্থানরত (হজ পালনরত) ব্যক্তির সাওম পালনের বিধান কি ? তিনি বললেন : রাসূলুল্লাহ স. আরাফার দিনে আরাফাতে অবস্থান কারীকে সাওম পালনে নিষেধ করেছেন।

মুসনাদে আহমদ- ২০৪/২, হাকেম ৪৬৫/১, আহমদ শাকের হাদিসটি সহীহ বলেছেন।

মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে : রাসূলে কারীম স. আরাফার দিনে আরাফাতে অবস্থান কালে পানাহার করেছেন। তার সাথে অবস্থানরত লোকজন তা দেখেছেন।

মুসলিম ১১২৩, ১১২৪

কোরবানি করা

এ দিনগুলোর দশম দিন সামর্থ্যবান ব্যক্তির কুরবানী করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার নবীকে কোরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন:

আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কোরবানি করুন।

সূরা কাওসার : ২

এ আয়াতে ঈদের সালাত আদায় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ও কোরবানির পশু জবেহ করতে আদেশ করা হয়েছে। তাই রাসূলুল্লাহ স. সারা জীবন কোরবানির ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন । হাদিসে এসেছে :—

সাহাবী ইবনে উমর রা. বলেছেন : নবী করীম স. দশ বছর মদিনায় ছিলেন, প্রতি বছর কুরবানী করেছেন।

আহমদ ও তিরমিযী, আহমদ হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন

নখ-চুল ইত্যাদি না কাটা

যারা কোরবানি করার ইচ্ছা করবে তাদের জন্য জিলহজ মাসের প্রথম থেকে কোরবানি করা পর্যন্ত নখ-চুল ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন জিলহজের প্রথম দশক শুরু হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে কোরবানি করবে সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে।

মুসলিম, হাদিস : ১৯৭৭

ঈদের সালাত আদায় করা

এটা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। একটি মত হল ঈদের সালাত ওয়াজিব। এ মতটাই অধিকতর শক্তিশালী।

মুসলিম হিসেবে কর্তব্য হবে ঈদের সালাতে আগ্রহ সহকারে অংশগ্রহণ করা, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনা, এবং ঈদের প্রচলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা- ভাবনা করা। মনে রাখতে হবে ঈদের দিনটা আল্লাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও সৎ-কাজ করার দিন। এ দিনটা যেন গান-বাজনা, মদ্যপান, অশালীন বিনোদন—প্রভৃতি পাপাচারের দিনে পরিণত না করা হয়। কেননা অনেক সময় এ সকল কাজ-কর্ম নেক আমল বরবাদ হওয়ার কারণে পরিণত হয়।

আইয়ামে তাশরীক এর ফজিলত

আইয়ামে-তাশরীক বলা হয় কোরবানির পরবর্তী তিন দিনকে। অর্থাৎ জিলহজ মাসের এগারো, বারো ও তেরো তারিখকে আইয়ামে-তাশরীক বলা হয়। তাশরীক শব্দের অর্থ শুকানো। মানুষ এ দিনগুলোতে গোশত শুকাতে দিয়ে থাকে বলে এ দিনগুলোর নাম ‘আইয়ামে-তাশরীক’ বা ‘গোশত শুকানোর দিন’ নামে নামকরণ করা হয়েছে।

এ দিনগুলোর ফজিলত সম্পর্কে যে সকল বিষয় এসেছে তা নিচে আলোচনা করা হল :—

(১) এ দিনগুলো এবাদত-বন্দেগি, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জিকির ও তার শুকরিয়া আদায়ের দিন। আল্লাহ তাআলা বলেন :—

তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করবে।

সূরা বাকারা : ২০৩

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী রহ. বলেন :—

ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন— নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে আইয়ামে-তাশরীককে বুঝানো হয়েছে।

ফতহুল বারী, ঈদ অধ্যায়

ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন : ইবনে আব্বাসের এ ব্যাখ্যা গ্রহণে কারো কোন দ্বিমত নেই।

তাফসীর কুরতুবী

আর মূলত এ দিনগুলো হজের মৌসুমে মিনায় অবস্থানের দিন। কেননা হাদীসে এসেছে—

মিনায় অবস্থানের দিন হল তিন দিন। যদি কেউ তাড়াতাড়ি করে দু দিনে চলে আসে তবে তার কোন পাপ নেই। আর যদি কেউ বিলম্ব করে তবে তারও কোন পাপ নেই।

আবু দাউদ- ১৯৪৯, হাদিসটি সহিহ

হাদিসে এসেছে—

নাবীশা হাজালী থেকে বর্ণিত যে রাসূলে কারীম স. বলেছেন : আইয়ামে তাশরীক হল খাওয়া-দাওয়া ও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জিকিরের দিন।

মুসলিম- ১১৪১

ইমাম ইবনে রজব রহ. এ হাদিসের ব্যাখ্যায় চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেন : আইয়ামে তাশরীক এমন কতগুলো দিন যাতে ঈমানদারদের দেহের নেয়ামত তথা স্বাচ্ছন্দ্য এবং মনের নেয়ামত তথা স্বাচ্ছন্দ্য একত্র করা হয়েছে। খাওয়া- দাওয়া হল দেহের খোরাক আর আল্লাহর জিকির ও শুকরিয়া হল হৃদয়ের খোরাক। আর এভাবেই নেয়ামতের পূর্ণতা লাভ করল এ দিনসমূহে।

লাতায়েফুল মাআরেফ : ইবনে রজব র. পৃ-৫০৪

(২) আইয়ামে তাশরীকের দিনগুলো ঈদের দিন হিসেবে গণ্য। যেমন হাদিসে এসেছে—

সাহাবী উকবা ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলে কারীম স. বলেছেন: আরাফাহ দিবস, কোরবানির দিন ও মিনার দিন সমূহ (কোরবানি পরবর্তী তিন দিন) আমাদের ইসলাম অনুসারীদের ঈদের দিন।

আবু দাউদ-২৪১৩, হাদিসটি সহিহ

(৩) এ দিনসমূহ যিলহজ মাসের প্রথম দশকের সাথে লাগানো। যে দশক খুবই ফজিলতপূর্ণ। তাই এ কারণেও এর যথেষ্ট মর্যাদা রয়েছে।
(৪) এ দিনগুলোতে হজের কতিপয় আমল সম্পাদন করা হয়ে থাকে। এ কারণেও এ দিনগুলো ফজিলতের অধিকারী।

আইয়ামে তাশরীকে করণীয়

এ দিন সমূহ যেমনি ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আযকারের দিন তেমনি আনন্দ- ফুর্তি করার দিন। যেমন রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : আইয়ামে তাশরীক হল খাওয়া- দাওয়া ও আল্লাহর জিকিরের দিন।

মুসলিম-১১৪১

এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দেয়া নেয়ামত নিয়ে আমোদ-ফুর্তি করার মাধ্যমে তার শুকরিয়া ও জিকির আদায় করা। জিকির আদায়ের কয়েকটি পদ্ধতি হাদিসে এসেছে।

(১) সালাতের পর তাকবীর পাঠ করা। এবং সালাত ছাড়াও সর্বদা তাকবীর পাঠ করা। এ তাকবীর আদায়ের মাধ্যমে আমরা প্রমাণ দিতে পারি যে এ দিনগুলো আল্লাহর জিকিরের দিন। আর এ জিকিরের নির্দেশ যেমন হাজীদের জন্য তেমনই যারা হজ পালনরত নন তাদের জন্যও।

(২) কোরবানি ও হজের পশু জবেহ করার সময় আল্লাহ তাআলার নাম ও তাকবীর উচ্চারণ করা।

(৩) খাওয়া-দাওয়ার শুরু ও শেষে আল্লাহ তাআলার জিকির করা। আর এটা তো সর্বদা করার নির্দেশ রয়েছে তথাপি এ দিনগুলোতে এর গুরুত্ব বেশি দেয়া। এমনিভাবে সকল কাজ ও সকাল-সন্ধ্যার জিকির গুলোর প্রতি যত্নবান হওয়া।

(৪) হজ পালন অবস্থায় কংকর নিক্ষেপের সময় আল্লাহ তাআলার তাকবীর পাঠ করা।

(৫) এগুলো ছাড়াও যে কোন সময় ও যে কোন অবস্থায় আল্লাহর জিকির করা।

Share the Post

Rate the Post

Rating Summary

0.0
0.0 out of 5 stars (based on 0 reviews)
Excellent0%
Very good0%
Average0%
Poor0%
Terrible0%

Latest Reviews

There are no reviews yet. Be the first one to write one.

Latest Book

Scroll to Top