বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; আজকের আলোচনার মূল বিষয় হলো ফিতরা দেওয়ার নিয়ম ও ফিতরার পরিমাণ কত। এই মর্মে অনেক মতভেদ আলেমগণের মধ্যে দেখা যায়; তাই এই বিষয়ে কিছু আলোচনা করতে চাই; যেন আমরা সঠিকভাবে যাকাতুল ফিতর বা সদকাতুল ফিতর প্রদান করতে পারি।
Table of Contents
Toggleফিতরা শব্দের অর্থ কি বা যাকাতুল ফিতর কি
যাকাতুল ফিতর একটি যৌগিক শব্দ; যা যাকাত ও ফিতর এর সমন্বয়ে গঠিত; সুতরাং যাকাতের আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, পবিত্রতা লাভ করা এবং প্রশংসা অর্থেও ব্যবহার হয়ে থাকে।
আর ফিতরের অর্থ হল রোজা ভঙ্গ করা, সৃষ্টি করা, বিদীর্ণ করা ইত্যাদি। যাকাতুল ফিতরের শরয়ী অর্থ হল: রোজা পালনকারীর বেহুদা কথাবার্তা ও অশ্লীলতার কাফফারা হিসেবে এবং মিসকিনদের আহারের ব্যবস্থার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে শেষ রোযা পূর্ণ হওয়ার পর নির্দিষ্ট পরিমাণে যে মাল (খাদ্য দ্রব্য) দেয়া হয় তাকে যাকাতুল ফিতর বলা হয়।
আবু দাউদ হাঃ ১৬০৯, ইবনু মাজাহ হাঃ ১৮২৭, দারাকুতনী ২/১৪০, আল হাকেম ১/৪০৯।
ফিতরের অন্যান্য নাম কী
বিভিন্ন হাদীসের বর্ণনা থেকে ফিতরার বিভিন্ন নাম পরিলক্ষিত হয় যা নিম্নে তুলে ধরা হল :
১। সাদাকাতুল ফিতর (ভঙ্গ করার দান)
২। যাকাতুল ফিতর (ভঙ্গ করার যাকাত)
৩। যাকাতুর রমজান (রমজানের যাকাত)
৪। যাকাতুল আবদান (দেহের যাকাত)
৫। যাকাতুস সাওম (রােযার যাকাত)
৬। সাদাকাতুর রুউস (মাথাপিছু সাদাকাহ)
সাদাকাতুল ফিতরের বিধান বা হুকুম
ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, প্রত্যক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের উপর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আদায় করা ফরয করেছেন এবং লোকজনের ঈদের সালাতের বের হবার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।
বুখারী হা : ১৫০৩, মুসলিম হাঃ ৯৮৩, আবু দাউদ হাঃ ১৬১১, তিরমিযী হা ৬৭৬, ইবনু মাজাহ হাঃ ১৮২৬।
যাকাতুল ফিতর কখন ফরজ হয়
দ্বিতীয় হিজরী সনে রমাযান মাসে ঈদুল ফিতরের দুদিন আগে যাকাতুল ফিতর ফরয হয়।
যাকাতুল ফিতর ফরজ হওয়ার হিকমত বা তাৎপর্য কী
যাকাতুল ফিতর ফরজ হওয়ার হিকমত বা তাৎপর্য নিম্নরূপ :
ক. রোজা পালনকারীর বেহুদা কথাবার্তা ও অশ্লীলতার কাফফারা এবং মিসকিনদের আহারের ব্যবস্থা।
আবু দাউদ হাঃ ১৬০৯, ইবনু মাজাহ হাঃ ১৮২৭।
খ. আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে যে, বান্দা তাঁর ফরয কৃত রােযা পূরণ করতে পেরেছে।
গ. ফিতরার মধ্যে আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ নিহিত আছে। আমরা রোজা রেখে অনেক সময় ইসলামী শরীয়ত বিরোধী ছোটখাটো ভুল-ত্রুটি করে থাকি। যাকাতুল ফিতর এসব পাপের সংশোধন করে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি অর্জন করে, যার ফলে আমাদের অপূর্ণ রােযাকে পূর্ণ করে। আর অন্যদিকে যাকাতুল ফিতর আদায়ের ফলে মিসকীনদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা মোচন হয়। ফলে তারা সমাজের অন্যান্যদের সাথে ঈদ অনুষ্ঠানে সানন্দে অংশগ্রহণ করতে পারে।
নবী করীম সঃ কতদিন যাকাতুল ফিতর আদায় করেছেন
নবী করীম সঃ জীবদ্দশায় নয় বছর রোজা পেয়েছেন এবং নয় বছর যাকাতুল ফিতর আদায় করেছেন।
যাকাত ও ফিতরার মধ্যে পার্থক্য কি
উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হল :
যাকাত একটি স্বতন্ত্র বিধান আর যাকাতুল ফিতর হল রমজানের রোজার সাথে সম্পৃক্ত, তাছাড়া যাকাতুল ফিতর ফরয হয় যাকাত ফরজ হওয়ার পূর্বে। তাই এ দুটি বিধানকে এক সাথে মিলিয়ে ফেলার কোন যুক্তিই থাকতে পারে না।
ফাতহুল বারী হাঃ ২/২২১, নাসাঈ হাঃ ২৫০৬, ইবনু মাজাহ হাঃ ১৮২৮।
ফিতরা কার উপর ওয়াজিব
প্রত্যেক মুসলিম ক্রীতদাস, আযাদ পুরুষ-নারী এবং ছােট-বড় সকলের উপর ফিতরা আদায় করা ফরয।
বুখারী হাঃ ১৫০৩, মুসলিম হাঃ ৯৮৩, আবু দাউদ হাঃ ১৬১১, তিরমিযী হা ৬৭৬, ইবনু মাজাহ হাঃ ১৮২৬, নাসাঈ হাঃ ২৫০০।
বেরােযাদার ব্যক্তির উপর যাকাতুল ফিতর আদায় করা ফরয কি না
বেরােযাদার ব্যক্তির উপর ফিতরা আদায় করা ফরয।
ইবনে উমার রাঃ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সঃ মুসলিম নর-নারী, স্বাধীন গোলাম, ও ছােট-বড় প্রত্যেকের উপর এক সা’ ফিতরা ফরজ করেছেন।
বুখারী হাঃ ১৫১১, মুসলিম হাঃ ৯৮৩।
উপরিউক্ত হাদীসের ভিত্তিতে ‘মুসলিম’ শব্দটি আম। তাই কেউ রােযা রাখুক আর না রাখুক উভয় অবস্থাতেই তার উপর ফিতরা আদায় করা ফরয।
তেমনিভাবে, হাদীসে উল্লেখিত সাগীর তথা ছোট সন্তানের উপর রোজা ফরজ না হওয়া সত্ত্বেও তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ফরয।
সুতরাং ফিতরা আদায় রোজা রাখার সাথে শর্ত নয় কেননা ফিতরা আদায়ের উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি হল মিসকিনদের খাদ্যের ব্যবস্থা।
আবু দাউদ হাঃ ১৬০৯, ইবনু মাজাহ হাঃ ১৮২৭।
রোজাদার ব্যক্তির উপর যাকাতুল ফিতর কোন সময় ফরজ হয়
রমজানের শেষ তারিখ সূর্যাস্তের সময় যাকাতুল ফিতর ফরয হয়ে যায়।
মিরআত- ৩/৯২, মাজমু ফাতাওয়া উসাইমিন প্রশ্ন নং ১৬৪, ১৬৫ পৃ ১৮/২৫৭।
উল্লেখ্য যে, যদি কেউ শেষ রমাযানের সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পূর্বে বিয়ে করে কিংবা ক্রীতদাসের মালিক হয় অথবা কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করে কিংবা কেউ ইসলাম কবুল করে অথবা আর্থিক স্বচ্ছলতা লাভ করে তাহলে তাদের সকলের উপর যাকাতুল ফিতর ফরয।
আর যদি সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পর বিয়ে করে কিংবা ক্রীতদাসের মালিক হয় অথবা কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করে তাহলে তাদের কারো উপরে যাকাতুল ফিতর ফরয নয়।
আবার যদি কেউ সূর্যাস্তের অল্প কিছুক্ষণ পর মারা যায় তাহলে সেই মৃত ব্যক্তির উপর যাকাতুল ফিতর ফরয। আর যদি সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট পূর্বে মারা যায় তাহলে তার উপর যাকাতুল ফিতর ফরয হবে না।
মাজালিসু শাহরি রামাযান, পৃ ১৩৮, ফিকহী প্রশ্নোত্তর প্রশ্ন নং-৯২ পৃঃ ২/৭৭, আল মুগনী পৃ ৩/৬৭, মিরআত- পৃ ৩/৯২।
ফিতরা কখন আদায় করতে হয়
ঈদের সালাত পড়তে যাওয়ার আগেই তা আদায় করতে হবে। এটা আল্লাহর নবী সঃ এর নির্দেশ।
বুখারী- হাঃ ১৫০৯, মুসলিম- হাঃ ৯৮৬, মিশকাত- হাঃ ১৮৩২, ফাতাওয়া লাজনা আদ দায়েমাহ ৯/৩৭৩।
আর যারা ঈদের সালাতের পর আদায় করবে তা সাধারণ দান হিসেবে পরিগণিত হবে।
আবু দাউদ- হাঃ ১৬০৯, ইবনু মাজাহ- হাঃ ১৮২৭।
আল্লামা ইবনে উসাইমীন ফিতরা আদায়ের দুটি সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন।
ক. ওয়াক্কুল জাওয়ায তথা বৈধ সময় অর্থাৎ ঈদের একদিন বা দু’দিন আগে আদায় করা।
খ. ওয়াক্কুল ফযীলত তথা উত্তম সময় অর্থাৎ ঈদের দিন সালাতের পূর্বে আদায় করা।
মাজমু ফাতাওয়া উসাইমিন প্রশ্ন নং ১৭৯ পৃঃ ১৪/২৬৬।
আল্লামা উবাইদুল্লাহ রাহমানী তিনটি মত উল্লেখ করেছেন।
ক. ওয়াক্কুল ওজুব তথা ওয়াজেব সময় অর্থাৎ রমজানের শেষ তারিখ সূর্যাস্তের সময়।
খ. ওয়াক্কুল কারাহাত তথা মাকরূহ সময় অর্থাৎ বিনা কারণে ঈদের সালাতের পর ফিতরা আদায় করা মাকরূহ।
গ. ওয়াক্কুল হুরমাত তথা হারাম সময় অর্থাৎ ঈদের পরের দিন বিনা কারণে বের করা হারাম।
মিরআত-৩/১০২-১০৩।
উক্ত মত সমূহের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
১। মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলীদের নিকট ঈদের পরের দিন বিনা কারণে ফিতরা আদায় করা হারাম।
২। ইমাম শাওকানী, ইবনুল কাইয়েম এবং ইবনে হাযম বলেন, ঈদের সালাতের আগে ফিতরা বের করা ওয়াজিব পরে বের করা হারাম। কারণ সালাতের আগে ফিতরা বের করার সময়টা শুধু উত্তম সময় নয় বরং আদায় করা ওয়াজেব সময়। সালাতের পর আদায় করা শুধু মাকরূহ নয় বরং হারাম। আল্লামা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী ও দ্বিতীয় মতটি সঠিক বলেছেন।
৩। ইবনে কুদামা বলেন, ঈদের দিনের পর দেরি করলে গুনাহগার হবে এবং তার উপর ফিতরা কাযা হবে।
৪। ইবনে রাসলান বলেন, ঈদের দিনের পর ফিতরা আদায় করা সকলেরই মতে হারাম। কারণ এটা হল যাকাত। সুতরাং এটা নির্দিষ্ট সময়ে না দিলে পাপ হবে, যেমন সময় মত সালাত না পড়লে গুনাহ হয়।
ফিতরা কোন সময় বন্টন করতে হবে
আবু দাউদ ১৬০৯ ও ইবনে মাজাহ ১৮২৭ নং হাদীসের ভিত্তিতে “আদ্দা” শব্দের অর্থে ওলামায়ে কেরাম দুটি মত পোষণ করেছেন :
প্রথম মত : “আদ্দা” শব্দের অর্থ ঈদের সালাতে যাওয়ার পূর্বেই জমাকারীর নিকট ফিতরা জমা করা মাত্র, বণ্টন করা নয় (আর এটাই আমাদের দেশের প্রচলিত নিয়ম)।
দ্বিতীয় মত : “আদ্দা” শব্দের অর্থ ঈদের সালাতে যাওয়ার পূর্বেই জমা করে তা হকদারদের নিকট বন্টন করে পৌছে দেয়া।
হাদীসের মর্ম অনুযায়ী ফিতরার মাল দ্বিতীয় মতের ভিত্তিতে ঈদের সালাতে যাওয়ার পূর্বেই হকদারের নিকট বণ্টন করে পৌছে দেয়াই উত্তম বলে মনে করি।
যাতে রােযার ত্রুটি সংশোধন হয় এবং মিসকীনকে ফিতরার মাল পেয়ে ভাল খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে এবং সবার সাথে বাৎসরিক ধর্মীয় আনন্দ অনুষ্ঠানে সানন্দে অংশ গ্রহণ করতে পারে।
এজন্যই আল্লামা ইবনে উসাইমীন ঈদুল ফিতরের সালাতকে দেরি করে পড়া উত্তম বলেছেন যাতে করে ফিতরা বণ্টন করা যায়।
আল্লামা বিন বায বলেন :
সুন্নাত হল যাকাতুল ফিতর ঈদের দিন সকালে ঈদের সালাতে যাওয়ার পূর্বেই ফকিরদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া তা ছাড়া ঈদের সালাতের এক অথবা দু’দিন আগে (২৮শে রমাযান) হতে দেয়া যায়।
বিন বায অন্য জায়গায় সালাতুল ঈদের আগেই দেয়া ওয়াজিব বলেছেন। তেমনি ভাবে আল্লামা ইবনে উসাইমীন বলেন :
ইবনে উমার ও ইবনে আব্বাসের হাদীসের ভিত্তিতে ঈদের সালাতের পর বিনা কারণে কেউ যাকাতুল ফিতর দিলে যাকাতুল ফিতর হিসেবে গৃহীত না হয়ে সাধারণ দানে তা পরিগণিত হবে।
বুখারী- হাঃ ১৫১১ ও মুসলিম- হাঃ ৬৮৩
কারণ যাকাতুল ফিতর এমন একটি ইবাদাত যা নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট আর তা হলাে ফরজ হওয়ার পর হতে সালাতে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই হকদারদের নিকট পৌছে দেয়া।
সুতরাং দেশের প্রচলিত প্রথা ঈদের পরে দুই বা তিন দিন ধরে বণ্টনকে পরিবর্তন করে, সুন্নাতী পদ্ধতি ঈদের সালাতে যাওয়ার আগেই বন্টন করার জন্য সবার প্রতি আমার উদাত্ত আহ্বান রইল।
তবে কয়েকটি কারণে ঈদের সালাতের পর বণ্টন করা যাবে। কারণ গুলো নিম্নরূপ:
(ক) সালাতের আগে বন্টন করতে ভুলে গেলে।
(খ) সালাতের পূর্ব পর্যন্ত কোন হকদার না পেলে।
(গ) এমন কোন মানুষ যে ঈদের দিন সম্পর্কে অজ্ঞ যেমন কোন মরুভূমি বা জনমানবহীন এলাকায় অবস্থান করে।
উল্লেখিত কারণ ব্যতীত ঈদের সালাতের পর ফিতরা বণ্টন বৈধ নয়।
ঈদের কয়দিন আগে যাকাতুল ফিতর দেয়া যায়
ঈদের দু একদিন আগে তা দেয়া যায়।
বুখারী- হাঃ ১৫১১, আবু দাউদ হাঃ ১৫৯৫।
যাদের কাছে ফিতরার মাল জমা করা হত তাদের কাছে ইবনু ওমর এক দিন বা দু’দিন আগে তার ফিতরা জমা দিতেন। অন্য বর্ণনায় তিনি তিন দিন আগে জমা দিতেন কথার উল্লেখ আছে।
মুয়াত্তা মালেক হাঃ ৩৪৪।
ফিতরা কি দ্বারা আদায় করতে হবে
দেশের প্রধান খাদ্য দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করতে হবে।
আবু সাঈদ খুদরী রাঃ বলেন, নবী সঃ এর যামানায় ঈদুল ফিতরের দিন আমরা এক সা’ খাদ্য ফিতরা দিতাম; তখন আমাদের খাদ্য ছিল যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর।
বুখারী হাঃ ১৫০৬, মুসলিম হাঃ ৯৮৫।
ধানের ফিতরা আদায় করা বা দেয়া যাবে কি না
আমাদের বাংলাদেশে প্রচলিত ধানের ফিতরা শরীয়ত সম্মত নয়। কারণ আমরা আমাদের দেশে প্রধানতঃ খাদ্য হিসেবে চাউলই ব্যবহার করে থাকি। সে হিসেবে চালেরই ফিতরা দিতে হবে। কারণ ধান আমাদের প্রধান খাদ্য নয় এবং সরাসরি আহার্য বস্তুও নয়। আর হাদীসে খাদ্যবস্তু (আম) দ্বারা ফিতরা দেয়ার কথা উল্লেখ আছে। আবার আমরা চালের মতই গমও খাদ্য হিসেবে ভক্ষণ করি। সে হিসেবে কেউ ইচ্ছে করলে গমের ফিতরা নিঃসন্দেহে আদায় করতে পারেন।
যারা ধানকে এদেশের প্রধান খাদ্য শস্য হিসেবে দাবী করে ধানের ফিতরা দিয়ে থাকেন, তাদের দাবি সম্পূর্ণ শরীয়ত বিরোধী ও অযৌক্তিক যা গ্রহণীয় নয়। কেন নয় তার শরয়ী ও বুদ্ধিভিত্তিক বক্তব্য ও আলেমদের মতামত নিম্নরূপ :
১। শরয়ী বক্তব্য :
আবু সাঈদ খুদরী রাঃ থেকে বর্ণিত হাদীসে তা’আম তথা খাদ্য বস্তু দ্বারা ফিতরা আদায়ের কথা উল্লেখ আছে।
বুখারী হাঃ ১৫১০।
২। বুদ্ধিবৃত্তিক বক্তব্য :
(ক) বাংলাদেশে যখন কোন এলাকা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন দেশের সরকার তাদের সাহায্যের জন্য চাল গম, আটা, তেল, ডাল ইত্যাদি খাদ্য সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হয়। কখনাে ধান দিয়ে সাহায্য করে না (যাকে রিলিফ বলা হয়)।
(খ) এ দেশের সরকার অনেক সময় কৃষকের নিকট হতে ধান ক্রয় করে তা গুদামজাত করে পরে আবার সে ধান চাল করে দেশের জনগণের সাহায্যার্থে ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কল্পে বিতরণ করে থাকেন।
(গ) বহিরাগত কোন দেশ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সাহায্য আসলে চাল, গম ছাড়া কোন দিন ধান আসতে দেখিনি অথবা এ দেশের সরকারও কোন দিন চাল গম ছাড়া খাদ্য হিসেবে ধান ক্রয় করে আনেনি।
(ঘ) এ দেশের রাস্তা ঘাট মেরামতের জন্য সরকার কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীতে চাল গম ছাড়া কখনো মুজুরী হিসেবে ধান প্রদান করে না।
(ঙ) দুস্থ ভাতা প্রদানের জন্য সরকার আটা, গম, চাল ছাড়া কোন দিন ধান প্রদান করে না।
(চ) এ দেশে ধানকে বৈধ মনে করে ফিতরা আদায় করা সত্ত্বেও তা জমা করার পর বিক্রি করে টাকা/পয়সা বিতরণ করে থাকে; তবুও ধান বিতরণ করা সহজ ও উপযোগী হয় না; তাহলে ধান কিভাবে ফিতরার দ্রব্য বলে বিবেচিত হবে?
(ছ) এমনকি বাড়ির গৃহপালিত পশুকেও আমরা ধান না দিয়ে চাল বা চালের খুদ এবং গম বা গমের ভূষি খাদ্য হিসেবে দিয়ে থাকি।
সুতরাং উল্লেখিত শরীয় ও বুদ্ধিভিত্তিক বক্তব্য দ্বারা বুঝা গেল যে, ফিতরার দ্রব্য ধান হিসেবে সম্পূর্ণ অযোগ্য।
৩। ধানের ফিতরা গ্রহণযােগ্য না হওয়ার ব্যাপারে আলিমগণের মতামত নিম্নরূপ:
(ক) ধানের ফিতরা দেয়া যাবে কি না প্রসংগে আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কুরাইশী তার “ফাতাওয়া ও মাসায়েল” গ্রন্থে ৩৩ জন আলেম মণ্ডলীর ফাতাওয়া উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে মাত্র ৮ জন বলেছেন, ধানের ফিতরা দেয়া যেতে পারে এই শর্তে যে, এতটুকু পরিমাণ ধান দিতে হবে যেন ধানের খোসা ছাড়িয়ে এক সা’ সমান আড়াই কেজি চাল বের হয় বা টিকে। বাকি ২৫ জন আলেম মণ্ডলী বলেন, চাল ছাড়া ধানের ফিতরা কখনও দেওয়া যাবে না।
তুষ, খোসা বা আঁটি সংযুক্ত বস্তুর ফিতরা
এক সা’ যব, গম ও খুর্মা হইতে তুষ, খােসা বা আঁটি ছাড়াইয়া লইলে ওজন কম বেশি যাহাই ঘটুক, সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার ব্যাপারে তাহা দ্রষ্টব্য নয়। রাসূলুল্লাহ ঃ খুর্মা, যব, গম, পনির ও কিশমিশের এক সা’ এবং সাধারণ আহার্যের এক ‘সা’ রমজানের ফিতরা ফরজ করিয়াছেন, পনির ও কিসমিস এর কিছুই বর্জনীয় না হইলেও ঐ গুলােরও এক ‘সা ফিতরাই নির্ধারণ করা হইয়াছে, খােসাযুক্ত ও খােশাবিহীনের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয়নি। মনসূস আজনাস অর্থাৎ যে সকল আহার্য সামগ্রীর কথা হাদীসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলির মধ্যে কিয়াসের অবসর নাই। যবের উপর কিয়াস খাটাইয়া ধানের ফিতরা জায়েজ হবে না, কারণ ধান আদৌ আহার্য সামগ্রী তাআম নয়। আহাৰ্যবস্তুর (আম) উপর কিয়াস করিয়া যব বা খুর্মার ফিতরা দেয়া হয় না মনসূস বলিয়াই দেয়া হইয়া থাকে। তা’আম বা আহার্য সামগ্রী রূপে ফিতরা দিতে হইলে এক সা’ চাউল দিতে হইবে।
তাছাড়া ও নিম্নোক্ত বিদ্বানগণ চাউলের ফিতরার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
১। ইবনুল কাইয়েম
২। আল্লামা বিন বায
৩। আল্লামা উসাইমীন
৪। আল্লামা সালেহ বিন ফাওযান
৫। আল্লামা উবায়দুল্লাহ মোবারকপুরী
সারকথা, নবী কারীম সঃ খেজুর, যব, গম, পনির ও কিশমিশ এবং তাআম (আহাৰ্যবস্তু) দ্বারা এক সা’ পরিমাণ রমজানের ফিতরা ফরজ করেছেন অতএব রােযাকে পরিশুদ্ধ করতে আমাদের এ দেশের প্রধান খাদ্য বস্তু চাল ছাড়া ধান দিয়ে ফিতরা দিলে হাদিসের পরিপন্থী হবে বলে আমি মনে করি। আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে সঠিক পন্থায় ফিতরা আদায় করার তৌফিক দেন।
ফিতরা কি টাকা দিয়ে আদায় হবে
টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করা বৈধ নয়, কারণ টাকা কোন সময় খাদ্য দ্রব্য হতে পারে না। আর খাদ্য দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায়ের কথা হাদীসের নির্দেশ।
একমাত্র ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছাড়া তিন ইমামের মতেও টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় অবৈধ।
তাছাড়া ইমাম আহমাদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, দিরহাম (মুদ্রা) দ্বারা যাকাতুল ফিতর আদায় করা যাবে কি না? উত্তরে তিনি বললেন, না। আবার লোকেরা বললেন যে, উমর বিন আবদুল আজিজ তাে ফিতরায় টাকা গ্রহণ করতেন। তিনি তখন অসন্তুষ্টি হয়ে বললেন যে, আল্লাহর নবী সঃ এর কথা বাদ দিয়ে অন্যের কথা বল যে, অমুক ব্যক্তি এ করেছে। বলেই তিনি ওমর বর্ণিত বুখারীর ১৫১১ নং হাদীস বর্ণনা করলেন যে, হাদীসে এক সা ফিতরা খাদ্যদ্রব্যই দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে।
সারকথা : আল্লামা ইবনে উসাইমীন বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা কুরআনে যেখানে যেখানে তা‘আম বা এতআম শব্দ ব্যবহার করেছেন সেখানে তাআম তথা খাদ্যই প্রদান করা ওয়াজিব যেমন :
(ক) অতি বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা মানুষ রোজা রাখতে সমর্থ না হলে তার রােযার বিনিময়ে ফিদিয়াহ হিসেবে মিসকীনদের তা‘আম (খাদ্যই) দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
সূরা বাকারা : ১৮৪।
(খ) কসম ভংগ কারীর কাফফারা হিসেবে মিসকীনদের কেও তা’আম (খাদ্যই) দেয়ার কথা উল্লেখ হয়েছে।
সূরা মায়েদা : ৮৯।
(গ) অনুরূপভাবে যাকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রে ও তাআম (খাদ্য) শব্দ দিয়েই ফিতরা আদায়ের কথা বলা হয়েছে।
অতএব উল্লেখিত জায়গায় কেউ যদি খাদ্যের বিনিময়ে ১০ গুন টাকাও প্রদান করে তাহলেও সেটা বৈধ হবে না।
বুখারী হাঃ ১৫১০।
কারণ ফিতরায় খাদ্যের কথা বলা হয়েছে তাই খাদ্যবস্তু দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হবে।
হানাফী গণ ফিতরায় খাদ্যদ্রব্যের বদলে মূল্য প্রদানের দলিল একটি কিয়াসের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন তা হল :
উটের যাকাতে জিযয়া ও মুসান্নাহর ক্ষেত্রে দুটি ছাগল গ্রহণ করা। যদি তা নির্দিষ্ট প্রাপ্য হতে কম হয় তাহলে এর সাথে দুটি ছাগল প্রদান করবে। আর ছাগল না পেলে বিশটি দিরহাম তার সাথে প্রদান করবে।
কিন্তু এখানে উটের বাচ্চার পরিবর্তে শুধু ছাগল বা শুধু দিরহাম প্রদান করতে হাদীসে বলা হয়নি; আল্লামা শানকিতি বলেছেন যে, যাকাত হচ্ছে ব্যাপক, যাতে মাল ও মুদ্রা উভয়টিই প্রযোজ্য হয়ে থাকে; আর ফিরা হচ্ছে নির্দিষ্ট একটি বস্তু, আর তা হলাে শুধুমাত্র ঈদের দিন দরিদ্র অসহায়দের ভক্ষণের ব্যবস্থা; সেহেতু এটাকে যাকাতের সাথে কিয়াস বা তুলনা করা ঠিক নয়।
যারা টাকার ফিতরা আদায় করাকে উমার বিন আবদুল আযীয, আবু ইসহাক, আতা, হাসান বসরী প্রমুখ তাবিঈনদের আমল মনে করে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন তাদের প্রতিউত্তর নিম্নরূপ :
তাবিঈনদের আমল দলিল হওয়ার মূলনীতি হলো : সরাসরি রাসূল সঃ ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে সুস্পষ্ট কোন আমল না পাওয়ার প্রেক্ষিতেই কেবলমাত্র তাবিঈনদের আমল দলিল হতে পারে, অন্যথায় নয়। তাই ফিতরার বস্তুর ক্ষেত্রে রাসূল ও সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট ও বিশুদ্ধ একাধিক হাদীস বিদ্যমান। সুতরাং এখানে তাবিঈনদের আমল কিভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? তাছাড়া আল্লামা শানকিতি বলেন, মূল্য দ্বারা ফিতরা আদায় করলে ইসলামী দুটি মূলনীতির বিরোধী হয়ে যায়। যথা :
এক: রাসূলুল্লাহ সঃ যখন বিভিন্ন প্রকার খাদ্য বস্তু দ্বারা ফিতরা প্রদানের কথা বলেছেন তখন উহার মূল্যের কথা বলেননি। যদি বৈধ হত তাহলে অবশ্যই বলতেন, যেরূপ উটের যাকাতের ক্ষেত্রে তার বিকল্প হিসাবে মূল্যের কথা বলেছেন।
দুই: সাধারণ নিয়ম হল কোন আসল বস্তু উপস্থিত থাকলে শাখা বস্তুর দিকে উহা স্থানান্তর হয় না; হ্যা যদি আসল না থাকে তখন শাখা তার স্থান দখল করে; মূল বস্তুর উপস্থিতিতে শাখা আসলের স্থান দখল করার শামিল, আর তা অবৈধ; দ্রুপ ফিতরার ক্ষেত্রে শাখা হচ্ছে মূল্য (টাকা-পয়সা) আর আসল বস্তু হচ্ছে খাদ্য, ঐ আসল পরিত্যাগ করে শাখা প্রাধান্য দেয়া যেরূপ অবৈধ, খাদ্য আদায় না করে মূল্য আদায় করাও তদ্রুপ অবৈধ।
অনেক মনীষীগণ বলেছেন যে, হানাফী গণ হজ্জের সময় মিনাতে জানোয়ার কুরবানী করা কষ্ট ভেবে উহার মূল্য দান করা বৈধ মনে করেন না; কারণ কুরবানী একটা ইবাদাত; তাহলে এক্ষেত্রে কেন মূল্য বৈধ করে থাকেন? অথচ এটাও একটি ইবাদাত।
মোটকথা, ফিতরা আদায়ের ক্ষেত্রে খাদ্যবস্তুর পরিবর্তে তার মূল্য প্রদান করা সরাসরি রাসূল সঃ এর উক্তি ও কর্মের বিরোধিতা করা; আর তিনি সঃ বলেছেন, যে ব্যক্তি এমন কাজ করলো যার প্রতি আমার উক্তি নেই তা অগ্রাহ্য।
মুসলিম হাঃ ১৭১৮।
তেমনি ভাবে সেটা সাহাবিদের আমলেরও পরিপন্থী এ ক্ষেত্রে রাসূল সঃ বলেন : তোমরা আমার পরে আমার সুন্নাত সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করবে অতঃপর সঠিক পথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত আঁকড়ে ধরবে।
আবু দাউদ হাদিস নং- ৪৬০৭, তিরমিযী হাদীস নং- ২৬৭৬।
তাই যাকাতুল ফিতর একটি ফরজ ইবাদাত, নির্দিষ্ট বস্তুতে ও নির্দিষ্ট সময়ে; যেরূপ নির্ধারিত সময়ের বাইরে (স্ব-ইচ্ছায়) আদায় করলে আদায় হবে না; তদ্রূপ হাদীসে উল্লেখিত খাদ্য বস্তুর বাইরে অন্য কিছু দ্বারা আদায় করলে তা আদায় হবে না।
ফিতরার পরিমাণ কত
বিভিন্ন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, ফিতরার পরিমাণ এক সা’।
আবু সাঈদ খুদরী রাঃ বলেন, আমরা নবী সঃ এর যুগে ঈদুল ফিতরের দিনে এক সা’ ফিতরা বের করতাম।
বুখারী পৃ ২০৪, মুসলিম ১/৩১৮, মিশকাত পৃ ১৬০, নাসাঈ ১/২৭০, আবু দাউদ- হাঃ ২২৮, তিরমিযী ১/১৩২।
এক সা পরিমাণ কত কেজি
সা’ দু’ প্রকার যেমন : সায়ে হেজাজী- তথা মক্কা মদিনার ‘সা’ অপরটি ইরাকী; হেজাজী সা’ ইরাকী ‘সা’-এর চেয়ে ওজনে কম; আর হেজাজী সা-ই-নাবী সঃ এর সা’ যার পরিমাণ ৫.৩৩ রতল।
তিরমিযী ১/৮০।
মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমীন (রহ:) নাবী সঃ এর যুগের একটি ‘সা’ তার শহর উনাইযা হতে পেয়েছেন; সেইটিই সা’ সম্পর্কিত এ মতভেদের নিরসন বা সমাধান; যায়েদ বিন সাবিত রাঃ ব্যবহৃত তামার ‘সা’ টিতে সর্বোত্তম গম ঢেলে ভর্তি করার পর সেই গমকে দাঁড়িপাল্লায় মেপে ওজন পাওয়া গেছে ২ কেজি ৪০ গ্রাম; কাজেই বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন মাপের দিকে ভ্রুক্ষেপের দরকার নেই।
মাপার মত কোন যন্ত্র না থাকলে ফিতরা মেপে বের করার পদ্ধতি কী
মাপার মত কোন যন্ত্র (দাঁড়িপাল্লা) না থাকলে পরিণত ও প্রমাণ গঠনের মানুষের দু’হস্তের মিলিত চার অঞ্জলীকে ‘সা’ বলা হয়। সকল দলের বিদ্যানগণ এ বিষয়ে একমত যে, রাসূল সঃ এর সা’ এর পরিমাণ “চার মুদ” আর এ বিষয়েও মতভেদ নেই যে, প্রমান গঠনের মানুষের মিলিত হস্তদ্বয়ের তেলােকে (অঞ্জলী) আরবী ভাষায় মুদ বলা হয়। সুতরাং যে কেউ মতভেদ এড়াইতে চাহেন তাহার পক্ষে বর্ণিত পদ্ধতিতে চার অঞ্জলী ভর্তি আর কিছু বেশি চাল এক সা’ এর পরিবর্তে সাদাকাত বাহির করতে হইবে। অর্থাৎ ফিতরায় চার অঞ্জলী (খাবল) কিছু বেশি চাল বা গম প্রদান করলে তা ইনশা-আল্লাহ এক সা’ হবে। যা রাসূল সঃ তার নয় বছরের জীবদ্দশায় আদায় করেছেন।
ফিতরা পরিমাণের ক্ষেত্রে চার মাযহাবের মতামত কী
বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ এর হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী, ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল এবং জমহুর ওলামায়ে কেরাম বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির তরফ থেকে এক সা’ ফিতরা আদায় করা ফরয এবং তার কম হবে না।
মুয়াবিয়া রাঃ এর ব্যক্তিগত গবেষণা প্রসূত অভিমতের ভিত্তিতে একমাত্র ইমাম আবু হানীফার অভিমত হল আধা সা।
উল্লেখ্য যে, মুয়াবিয়া রাঃ যখন খলিফা হলেন এবং তিনি সিরিয়া থেকে লাল রং এর মােটা মােটা দানা বিশিষ্ট গম মদীনায় আমদানি করলেন এবং মুয়াবিয়া জুমার খুতবা প্রদানকালে বলে ফেললেন যে, আমি মনে করছি যে, সিরিয়ার গম এক মুদ আর মদিনার গম দুই মুদ সমান, অতএব সিরিয়ার গম আধা সা’ ফিতরা প্রদান করলে চলবে। একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য জনতার মধ্য হতে হাজার হাজার প্রবীণ সাহাবী প্রিয় নবী সঃ এর আইনের বিপরীত আইন পরিচালনার বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হয়ে সামনাসামনি প্রতিবাদ করেন। বিশেষভাবে আবু সাঈদ খুদরী মুয়াবিয়াকে এক জুমার মসজিদে অসংখ্য জনতার ভিড়ে ঘেরাও করে উত্তর চাইলেন যে, আপনি আধা সা’ ফিতরার কথা কেন বললেন? তখন মুয়াবিয়া নিরুপায় হয়ে বলেছিলেন যে, এটা আমার নিজস্ব রায় নিজস্ব মতামত।
বুখারী- ১/২০৪।
সুতরাং রাসূল সঃ প্রবর্তিত এক সা’ এর পরিবর্তে একজন সাহাবীর ব্যক্তিগত মস্তিষ্ক প্রসূত অভিমতকে (আধা সা) কোন বিবেকবান নবী সঃ প্রেমিক মুসলিমের জন্য গ্রহণ করা আমি বৈধ মনে করি না।
জমাকৃত যাকাতুল ফিতরের মাল বিক্রি করে তার টাকা-পয়সা বিতরণ করা যাবে কি না
যাকাতুল ফিতরের জমাকৃত মাল বিক্রি করে সে বিক্রিত টাকাপয়সা বিতরণ বা তা দিয়ে পরিধেয় কাপড় কিনে বিতরণ করা কোন অবস্থাতেই শরীয়ত সম্মত নয়। হকদার ফিতরা হস্তগতের পর ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করবে।
বুখারী হাঃ ১৫০৬, মাজমু ফাতাওয়া উসাইমিন প্রশ্ন নং-১৯০ পৃ ১৮/২৭৭।
আল্লামা উসাইমীন বলেন, খাদ্যের পরিবর্তে যেমন বাড়ীর ব্যবহৃত কোন মাল বিক্রি করে দেয়া যাবে না; তেমন জমাকৃত মাল বিক্রি করে কাপড় কিনে দেয়া যাবে না; সুতরাং খাদ্যের পরিবর্তে টাকার ফিতরা আদায় করা বা যাকাতুল ফিতরের জমাকৃত মাল বিক্রি করে টাকা দেয়া আল্লাহর নবীর নির্দেশের বিরোধিতা করা।
ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে
এ ব্যাপারে ইসলামী বিদ্যানগণের মাঝে দুটি অভিমত পরিলক্ষিত হয়, তা নিম্নরূপ:
১ম অভিমত : ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসের ভিত্তিতে যাকাতুল ফিতর শুধুমাত্র ফকির ও মিসকিনদের মাঝেই বিতরণ করতে হবে।
আবু দাউদ হাঃ ১৬০৯, ইবনু মাজাহ হাঃ ১৮২৭।
উক্ত মতের স্বপক্ষে ইমাম আহমদ, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়েম, আল্লামা মুহাম্মদ বিন ইসমাইল ইয়ামেনি এবং হানাফী গণের মধ্যে ইমাম কারখী ফিতরাকে শুধু ফকির মিসকিনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন।
২য় অভিমত: ইমাম শাফেয়ী, ইমাম ইবনে কুদামা, ইমাম কারখী, হাফিজ যারকাশী, হাফিয ইবনে হাযম, আল্লামা শাওকানী আর হানাফী মাযহাবের বিদ্যানগণের উক্তি এবং মুহাদ্দিস দেহলভীর সাক্ষ্য অনুসারে চার মাযহাবের প্রকাশ্য ফাতাওয়া সূত্রে ফিতরার যাকাত সম্পদের যাকাতের নিয়ম অনুযায়ী বন্টন করতে হবে।
তাদের দলিল: সূরা তাওবার ৬০ নং আয়াত, কারণ ফিতরা ও সম্পদের যাকাত উভয় বস্তুই রাসূল সঃ এর পবিত্র মুখে সাদাকাত’ নামে আখ্যাত হয়েছে মর্মে তারা যাকাতুল ফিতরকে আটটি খাতেই দিতে হবে বলে মত পোষণ করেছেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর হাদীস শাস্ত্রের বিখ্যাত পণ্ডিত আল্লামা আলবানী ২য় অভিমতের প্রতিবাদ করতঃ ১ম অভিমতকে ইবনে আব্বাসের হাদীসের ভিত্তিতে কেবল যাকাতুল ফিতর ফকির ও মিসকীনদের জন্যই সীমাবদ্ধ করেছেন। এবং ২য় অভিমতের প্রতিবাদটা তিনি এভাবে করেন : সূরা তাওবার ৬০ নং আয়াতটি যাকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রে নয় বরং মালের যাকাতের ক্ষেত্রেই বুঝানো হয়েছে। যার প্রমাণ তার পূর্বের ৫৮ নং আয়াত।
এটাই ইবনে তাইমিয়া ও শাওকানীর মত তাছাড়া ইবনুল কাইয়েম তার যাদুল মা’আদ গ্রন্থে যাকাতুল ফিতর একমাত্র মিসকিনদের জন্য নির্দিষ্ট করা রাসূল সা এর নির্দেশনা শিরোনামে উল্লেখ করেছেন।
হে পাঠকবৃন্দ! উভয়ের দলিলসহ দু’টি অভিমত উপস্থাপন করা হল সিদ্ধান্ত আপনাদের।
ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে না
যাদের কে ফিতরা দেয়া যাবে না তারা হচ্ছে :
(১) যাদের যাকাত দেয়া বৈধ নয়।
(২) কোন ধনী ব্যক্তিকে।
(৩) ইসলামের দুশমনকে।
(৪) কাফেরকে।
(৫) মুরতাদকে।
(৬) ফাসেককে।
(৭) দুরাচারী বা ব্যভিচারিণীকে।
(৮) রোজগার করার ক্ষমতা রাখে এমন ব্যক্তিদের।
(৯) জিম্মি ব্যক্তিকে।
(১০) নিজের স্বামীকে।
(১১) নিজের স্ত্রীকে।
(১২) নিজের পিতাকে এবং নিজের সন্তান সন্ততিকে।
(১৩) কুরাইশ বংশের হাশিম বংশধরদের কে ফিতরা দেয়া যাবে না।
(১৪) মসজিদ নির্মাণে অথবা কল্যাণমূলক কাজে যাকাতুল ফিতর দেওয়া যাবে না।
ফিতরার মাল এক জায়গায় জমা করা যায় কি না
ইবনে উমর হতে বর্ণিত সাহাবারা ঈদুল ফিতরের একদিন কিংবা দুই দিন পূর্বেই আদায়কারীর নিকট ফিতরা জমা দিতেন; তিনি আরো বলেন, সাহাবারা আদায়কারীর নিকট ফিতরা জমা দিতেন সরাসরি গরিবদেরকে দিতেন না।
বুখারী পৃ ২০৫, আবু দাউদ ১/২২৭।
তাছাড়া নাফে বর্ণনা করেন, ইবনে উমর ঈদের দুই বা তিন দিন পূর্বে সদকাতুল ফিতর জমাকারী কর্মচারীর নিকট স্বীয় ফিতরা পাঠিয়ে দিতেন।
বাংলা মুয়াত্তা-১/৩৫৪।
তাহলে হাদিস থেকে প্রমাণিত হল যে, সরাসরি হকদারকে না দিয়ে জমাকারীর নিকট জমা দিয়ে তারপর বণ্টন করতে হবে।
অতএব বন্টনের সুশৃঙ্খলতা রক্ষার্থে এক জায়গায় জমা করে তা বণ্টন করাই শ্রেয়।
কারো উপর ফিতরা ফরজ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট নিসাব কি
যাকাতুল ফিতর ফরয হওয়ার জন্য নির্ধারিত নিসাব থাকা শর্ত নয়।
তবে এ ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ী (রহ:) বলেন, যে ব্যক্তি ঈদের দিনে তার নিজের ও তার পরিবারের দুই ওয়াক্তের ও বেশি খাবারের ব্যবস্থা আছে, তার উপর ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করতে হবে। আর যার কাছে মাত্র এক ওয়াক্তের খাবার আছে তার উপর ফিতরা আদায় করা জরুরী নয়।
ইমাম আহমদ ও ইমাম মালেক (রহ:) ও উক্ত মত পোষণ করেছেন।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বিষয়গুলি সঠিকভাবে বুঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুক। আল্লাহুম্মা আমীন।