রমজানের প্রস্তুতি যেভাবে নেবেন. পবিত্র রমজান মাসের প্রস্তুতি

রমজানের প্রস্তুতি যেভাবে নেবেন. পবিত্র রমজান মাসের প্রস্তুতি

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে রমজানের প্রস্তুতি হিসাবে আমাদের কি কি কাজ করা উচিত। পবিত্র রমজান মাস আসার আগেই রমজান মাসব্যাপী সিয়াম পালনের সংকল্প গ্রহণ করা অর্থাৎ নিয়াত করা একজন মুসলিমের জন্য একান্ত জরুরি। নিয়াত করার পর পরিকল্পনা করতে হবে যে কিভাবে আমি রমজান মাসকে অতিবাহিত করব। রমজান মাস একটি বিশেষ ফজিলত পূর্ণ মাস। রমজানের ফজিলতের বর্ণনা অল্প কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। পূর্বে আমরা রমজানের ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করেছি। তাই এখানে সে সম্পর্কে আলোচনা করতে চায় না। আপনারা আমার পূর্বের আলোচনা দেখে আসতে পারেন সেখানে বিস্তারিতভাবে রমজানের ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করেছি। রমজানের ফজিলত হাসিল করার জন্য  কিভাবে রমজানকে অতিবাহত করতে হবে অর্থাৎ কি কি ইবাদত করতে হবে তা পরিকল্পনা করার পর রমজান মাসের আগেই কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহে রমজানের মহাকল্যাণ হাসিলের জন্য অনেক আগে থেকেই মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন; তিনি শাবান, এমনকি রজব মাস থেকে মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন; আর এভাবে পূর্ব থেকে সংকল্প ও মানসিক প্রস্তুতি নেয়া থাকলেই কোনো কাজ সুন্দর, সুষ্ঠু ও পরিপাটি ভাবে পালন করা সম্ভব হয়।

রমজানের প্রস্তুতি হিসাবে যে কাজগুলো করা যেতে পারেঃ

১. মাহে রমজানের সময়কাল জানুন এবং দিন গুনুন

একজন মুসলিম মহা মর্যাদাপূর্ণ মাহে রমজানের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। তিনি দিন গুনতে থাকেন  কবে আসবে মাহে রমজান? কবে থেকে রোজা রাখব; মুসলিমদের কাছে মাহে রমজানের আগমন ঠিক এরকম, যেন: কারো আপনজন দূর বিদেশ থেকে প্লেনে করে বাড়ি ফিরছেন; এ দিকে বিমান বন্দরে এবং বাড়িতে তার স্বজনরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কখন এসে পৌঁছুবে প্লেন? কখন তিনি প্লেন থেকে নেমে আসবেন? কখন পৌছাবেন বাড়ি। মুসলিমদের কাছে মাহে রমজানের আগমনের অপেক্ষাটাও হয়ে থাকে এরকম ব্যাকুলতা নিয়ে। রমজান মাস আমাদের আপনজনের মতােই। সুতরাং ভালোভাবে জেনে রাখুন, আমরা যে ক্যালেন্ডার অনুসরণ করি সেই ক্যালেন্ডার অনুসারে কবে শুরু হতে যাচ্ছে রমজান মাস? অতঃপর দিন গণনা শুরু করুন।

২. রমজানে কোথায় অবস্থান করবেন তা আগেই স্থির করুন

রমজানে আপনি কোথায় অবস্থান করবেন? কর্মস্থলে? গ্রামের বাড়িতে নাকি সফর করবেন বাইরে? অবস্থানের স্থান বা এলাকা অনুযায়ী আপনার রমযানের কর্মসূচি প্রণয়ন করুন এবং সেভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিন।

৩. সিয়াম পালনে পরিবারের সদস্যদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করুন

আপনার নিজের মানসিক প্রস্তুতির সাথে সাথে আপনার পরিবারের সদস্যদের, নিকটাত্মীয়দের এবং অধীনস্থদেরও মাহে রমযানকে স্বাগত জানানোর এবং পুরো মাস সিয়াম পালনের জন্য মানসিকভাবে সচেতন ও প্রস্তুত করতে থাকুন। এ উদ্দেশ্যে পারিবারিক বৈঠক করুন। পরামর্শ করুন। মাহে রমজান সঠিকভাবে পালনের পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কিছু কিছু করে দায়িত্ব বন্টন করুন।

৪. আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও সমাজ-বন্ধুদের সচেতন করুন

সবাইকে বলুন রমজান আসছে, রােযা এসে যাচ্ছে, রােযার আর মাত্র এতাে দিন বাকি। এভাবে আপনার আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, ও সমাজবন্ধুদের মাহে রমযানের সিয়াম পালনের ব্যাপারে পূর্ব থেকে সচেতন করতে থাকুন। লােকদের সিয়াম শুরুর তারিখ জানানাের মধ্যেও রয়েছে নেকি এবং সওয়াব।

৫. অফিস-আদালত ও কাজ-কর্মের সময় পুনঃনির্ধারণ করুন

একজন মুসলিমকে রমযান মাসে তার দৈনন্দিন জীবন ধারায় কিছু পরিবর্তন আনতে হয়, কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনতে হয়, সময়সূচিতে পরিবর্তন আনতে হয়। তাকে পরিবর্তন আনতে হয়, তার নিদ্রা ও জাগ্রতর সময়সূচিতে, তার বিশ্রাম ও পানাহারের সময়সূচিতে, তার অফিস আদালতের সময় সূচিতে, তার কার্যক্রমের সূচিতে, তার আবাস থেকে বের হওয়া এবং আবাসে ফিরে আসার সময়সূচিতে। তা ছাড়া এ মাসে তার কর্মসূচিতে যোগ করতে হয় কিছু কিছু নতুন কার্যক্রম। এ মাসে সে কমিয়ে আনে তার জাগতিক কার্যক্রম আর বাড়িয়ে দেয় তার ইবাদত-বন্দেগি ও পুণ্য কর্মের ফলগুধারা। এ বিষয়গুলো সামনে রেখে আপনি আপনার গতানুগতিক জীবনধারার পরিবর্তন ও সময়সূচি রমজান আসার পূর্বেই পুনঃনির্ধারণ করে নিন।

৬. প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক প্রস্তুতি গ্রহণ করুন

রমযান শুরু হবার পূর্বেই এ মাসের জন্য অর্থনৈতিক প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। কয়েকটি কারণে এ মাসে একজন মুসলিমের অর্থ ব্যয় বেড়ে যায়। যেমন: ১. রোজাদারদের ইফতার করানোর কারণে। ২. বেশি বেশি দান-সদকা করার কারণে। ৩. মজুতদার ও অসৎ ব্যবসায়ীদের দ্বারা দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে। ৪. অনেকেই এ মাসে বার্ষিক যাকাত প্রদান করেন। ৫. ঈদুল ফিতর উদযাপনকে সামনে রেখে। ৬. ফিতরা আদায়ের কারণে। সুতরাং এসব খাতে এবং কারণে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয়ের জন্য আপনিও প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।

৭. বাজার স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত রাখতে উদ্যোগ নিন

নীতি নৈতিকতার দিক থেকে আমাদের সমাজ পুরোপুরি সৎ ও স্বচ্ছ না হবার কারণে দেখা যায়, রমজান মাসেও খাদ্যে ভেজাল, মাপ জোপে হেরফের, ফটকা বাজারি, প্রতারণা ও মূল্য বৃদ্ধির অদম্য প্রবণতা বিদ্যমান থাকে। ফলে রোজাদার জনগণকে প্রচুর ভোগান্তির শিকার হতে হয়। বাজার স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত রাখার ক্ষেত্রে একজন সচেতন নাগরিক এবং একজন মুসলিম হিসেবে আপনারও রয়েছে বিরাট দায়িত্ব। আপনিও হয়তাে একজন ব্যবসায়ী, আইনজীবী, ডাক্তার, সরকারি চাকরিজীবী, প্রাইভেট চাকরিজীবী, পুলিশ, সেনা সদস্য, কারখানার মালিক, কারিগর, শিক্ষক, ছাত্র, কিংবা কৃষিজীবি বা অন্য কোনো কর্মজীবী। বাজার স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত রাখার ক্ষেত্রে আপনিও ভূমিকা পালন করুন। আপনি নিজের অবস্থানে নিজে স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত থাকুন। অন্যদেরকেও স্বচ্ছতার ব্যাপারে সচেতন করুন, উৎসাহিত করুন, উদ্বুদ্ধ করুন। রমযান শুরু হবার আগে থেকেই একাজগুলাে করুন।

৮. সিয়াম পালনের উপযোগী পবিত্র পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নিন

মাহে রমজানের বিশেষ ও মহোত্তম পবিত্র মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে রমজান শুরু হবার আগে থেকেই সমাজে মানসিক ও বাস্তব পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করুন। এ উদ্দেশ্যে আগে থেকেই ১. জনগণকে সচেতন করতে থাকুন। ২. মসজিদের খতিব ও ইমাম সাহেবগণ খুতবায় এবং নামাযের আগে পরে আলােচনা করুন। ৩. ঘরে, মসজিদে, অফিস আদালতে কুরআন ও হাদিসের সিয়াম সংক্রান্ত আয়াত ও হাদিস গুলোর ব্যাপক পাঠ ও আলোচনা করুন। ৪. রমযানের ক্যালেন্ডার মুদ্রণ ও বিতরণ করুন। ৫. লিফলেট ও বুকলেট ছেপে বিতরণ করুন।

৯. মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের সুবিধা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করুন

রমযান মাসে মুসলিমগণ মহান আল্লাহ প্রদত্ত অবারিত রহমত, মাগফিরাত ও নেকি হাসিলের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন; পুরুষগণ দিনের এবং রাতের নামাজে ব্যাপকহারে মসজিদে আগমন করেন; আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে, শহরে কম হলেও বিশেষ করে মফস্বলের মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।

সুতরাং ব্যক্তিগত ও যৌথ উদ্যোগে মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ০১. স্থান সংকুলান না হলে স্থান সম্প্রসারণ করুন। ০২. ওযু খানার সুব্যবস্থা করুন। অযুর পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখুন। ০৩. প্রস্রাবখানা/ টয়লেট ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখুন। ০৪. মসজিদে ফ্যান না থাকলে, ফ্যান লাগানোর ব্যবস্থা করুন। ০৫. ফ্যানের স্বল্পতা থাকলে সংখ্যা বৃদ্ধি করুন। ০৬. বিদ্যুৎ লাইন না থাকলে বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ লাগান। ০৭. শহরের মসজিদগুলোতে যেখানে যেখানে সম্ভব এয়ার কন্ডিশনার লাগান। ০৮. মসজিদের জানালা দরজা ঠিকঠাক করে রাখুন। ০৯. মুসল্লিদের সুবিধার জন্য চাটাই/চট/কার্পেট ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখুন। ১০. যারা ইতেকাফ করবেন, তাদের সুন্দর ও সুরক্ষিত অবস্থানের জন্য ভালো ব্যবস্থা রাখুন। এগুলো এবং এ ধরনের আরো যেসব ব্যবস্থা প্রয়োজন ব্যক্তিগত উদ্যোগে যতােটা সম্ভব করুন। মসজিদ কমিটি এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করুন। এছাড়া আল্লাহ পাক যাদের বেশি তৌফিক দিয়েছেন তারা এগিয়ে আসুন।

১০. মসজিদে তারাবিহ বা রাতের নামাজের সুব্যবস্থা করুন

ব্যাপক সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে তারাবির নামাজে মুসল্লির ব্যাপক সমাগম হয়। এ উদ্দেশ্যে ১. সুন্দর সুললিত কণ্ঠে দীর্ঘ কুরআন তিলাওয়াতের উদ্দেশ্যে হাফেজদের দ্বারা তারাবি পড়ানোর ব্যবস্থা করুন। ২. তারাবির নামাজে দ্রুত কুরআন পাঠ না করে ধীরে ধীরে তারতিলের সাথে পাঠের ব্যবস্থা করুন। ৩. যেদিন কুরআনের যে অংশ পাঠ হবে ইমাম সাহেব বা হাফেজ সাহেব সেদিন নামায শুরুর আগেই সে অংশের অর্থ/মর্ম মুসল্লিদের শুনিয়ে দিন।

১১. মাহে রমজানকে স্বাগত জানান

শাবান শেষে রমজানের চাঁদ দেখুন; একা একা দেখুন, দলবেঁধে দেখুন; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখাে; তাই রমজানের চাঁদ দেখুন; এভাবে চাঁদ দেখার মাধ্যমে মাহে রমযানকে স্বাগত জানান এবং পুরো মাস রোজা রাখার তৌফিক চেয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।

Share the Post

Rate the Post

Rating Summary

0.0
0.0 out of 5 stars (based on 0 reviews)
Excellent0%
Very good0%
Average0%
Poor0%
Terrible0%

Latest Reviews

There are no reviews yet. Be the first one to write one.

Latest Book

Scroll to Top