তাহাজ্জুদ নামাজের সময়

তাহাজ্জুদ-নামাজের-সময়-কখন-শুরু-হয়

আজকে আলোচনা করতে চাই তাহাজ্জুদ নামাজের সময়, তাহাজ্জুদ নামাজের সময় কখন শুরু হয়, তাহাজ্জুদের শেষ সময়, তাহাজ্জুদ নামাজের আদব সম্পর্কে।

তাহাজ্জুদ নামাজের সময়

কিয়ামুল লাইলের সর্বোত্তম সময় রাতের শেষ তৃতীয়াংশ। রাতের সালাত রাতের শুরু, শেষ ও মধ্যখানে আদায় করা বৈধ, তবে উত্তম হচ্ছে শেষ তৃতীয়াংশ। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন মাসে পানাহার করতেন, এক সময় আমরা মনে করতাম তিনি এ মাসে সিয়াম পালন করবেন না। আবার কোন মাসে সিয়াম পালন করতেন, এক সময় আমরা মনে করতাম এ মাসে তিনি পানাহার করবেন না। তিনি এমন ছিলেন, যদি তুমি তাকে রাতে সালাত আদায়কারী দেখতে চাও দেখতে পাবে, আর যদি তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে চাও, তাও দেখতে পাবে।

সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১১৪১

এ থেকে রাতের সালাতের সহজ নিয়ম বুঝে আসে, যার যখন সুবিধা উঠে সালাত আদায় করবে। হ্যাঁ রাতের শেষ অংশে সালাত আদায় করা উত্তম। আমর ইবনে আবাসা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি নবী। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন:

রাতের শেষ ভাগে বান্দা তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়, যদি তুমি সে সময়ে আল্লাহর যিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পার, তাহলে তাদের অন্তর্ভুক্ত হও।

তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৭৯; আবু দাউদ, হাদীস নং ১২৭৭

এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস দ্বারা, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি। ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

আমাদের রব প্রতি রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন, যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকে। অতঃপর তিনি বলেন, কে আমাকে আহ্বান করবে, আমি যার ডাকে সাড়া দেব? কে আমার নিকট প্রার্থনা করবে, আমি যাকে প্রদান করব? কে আমার নিকট ইস্তেগফার করবে, আমি তাকে ক্ষমা করব? ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত অনুরূপ বলতে থাকেন।

সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৫৮

তাহাজ্জুদ নামাজের আদব

১. ঘুমের সময় কিয়ামুল লাইল এর নিয়ত করা

আর ঘুমের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ ইবাদাতে শক্তি অর্জন করা, তাহলে ঘুমেও সওয়াব হবে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

এমন কোন ব্যক্তি নেই, যার রাতে সালাত আদায়ের অভ্যাস ছিল, অতঃপর তার ওপর ঘুম প্রবল হল, আল্লাহ তার জন্য অবশ্যই সালাতের সওয়াব লিখবেন, আর তার ঘুম হবে তার জন্য সদকা।

নাসাঈ, হাদীস নং ১৭৮৪; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩১৪

আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

যে ব্যক্তি তার বিছানায় আসল, যার নিয়ত ছিল রাতে উঠে সালাত আদায় করা, কিন্তু তার ওপর ঘুম প্রবল হল, অতঃপর ভাের করল, তার নিয়ত অনুযায়ী তার জন্য লেখা হবে। আর তার ঘুম হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য সদকা স্বরূপ।

নাসাঈ, হাদীস নং ৬৮৭

২. জাগ্রত হয়ে হাত মলে চেহারা থেকে ঘুম দূর করা, আল্লাহর যিকির করা ও মিসওয়াক করা, এবং দোয়া পাঠ করা

উবাদা ইবনে সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে আড়মোড়া দিয়ে উঠে বলল: হে আল্লাহ আমাকে মাফ কর, তার দুআ কবুল করা হবে।

সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১১৫৪

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাগ্রত হয়ে হাত দ্বারা চেহারা থেকে ঘুম মুছতে ছিলেন, অতঃপর সূরা আল ইমরানের শেষ দশ আয়াত তিলাওয়াত করলেন।

সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮২-৭৬৩

হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে যখন ঘুম থেকে উঠতেন, মিসওয়াক দ্বারা তার মুখ দাঁতন করতেন।

সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৪

অতঃপর জাগ্রত হওয়ার অন্যান্য যিকির পড়া এবং আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক অযু করা।

৩. হালকা দুরাকাত সালাত দ্বারা তাহাজ্জুদ আরম্ভ করা

কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কর্ম দ্বারা অনুরূপ প্রমাণিত হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন রাতে সালাত আদায়ের জন্য উঠতেন, তিনি হালকা দুই রাকাত সালাত দ্বারা তার সালাত আরম্ভ করতেন।

সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৬৭

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

যখন তােমাদের কেউ রাতে সালাতের জন্য উঠে, সে যেন তার সালাত হালকা দু’রাকাত দ্বারা আরম্ভ করে।

সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৬৮

৪. ঘরে তাহাজ্জুদ আদায় করা

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। যায়েদ ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

তোমরা ঘরে সালাত আদায় কর, কারণ ব্যক্তির উত্তম সালাত হচ্ছে তার ঘরে ফরয ব্যতীত।

সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭৩১; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৮১

৫. নিয়মিত কিয়ামুল লাইল আদায় করা

কখনাে ত্যাগ না করা। নির্দিষ্ট সংখ্যক রাকাত নিয়মিত পড়া মুস্তাহাব যদি শরীর চাঙ্গা ও মন প্রফুল্ল থাকে, তাহলে দীর্ঘ কিরাত করবে, অন্যথায় হালকা কিরাতে সালাত আদায় করবে, আর কখনো ছুটে গেলে কাযা করবে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

তোমরা সে পরিমাণ আমল কর, যার সাধ্য তােমাদের রয়েছে, কারণ আল্লাহ ক্লান্ত হন না, যতক্ষণ না তোমরা ক্লান্ত হও। তিনি বলতেন: আল্লাহর নিকট সেই আমলই অধিক পছন্দনীয়, বান্দা যার ওপর নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখে, যদিও তার পরিমাণ কম হয়।

সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯৭০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৮২

৬. যদি তন্দ্রা চলে আসে, তাহলে সালাত ত্যাগ করে ঘুমানো

এটা উত্তম, যেন ঘুম পূর্ণ হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

যখন তোমাদের কেউ সালাতে ঝিমায়, তার উচিৎ শুয়ে পড়া, যেন তার থেকে ঘুম চলে যায়। কারণ, ঘুমানো অবস্থায় যখন তােমাদের কেউ সালাত আদায় করে, তখন হয়তো সে নিজের জন্য ইস্তেগফার করতে গিয়ে নিজেকে গালি দেবে।

সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২১২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৮৬

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘মারফু’ সনদে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন:

যখন তােমাদের কেউ রাতে দন্ডায়মান হয়, অতঃপর তার জন্য যদি কুরআন পড়া কষ্টকর হয়, কী বলে বলতে পারে না, তাহলে সে যেন শুয়ে পড়ে।

সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৮৭

৭. রাতের সালাতের জন্য স্ত্রীকে জাগ্রত করা মুস্তাহাব

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

আল্লাহ সে ব্যক্তিকে রহম করুন, সে রাতে উঠে সালাত আদায় করল, অতঃপর তার স্ত্রীকে জাগ্রত করল। যদি সে উঠতে না চায় তার চেহারায় পানির ছিটা দিল। আল্লাহ সে নারীর ওপর রহম করুন যে রাতে উঠে সালাত আদায় করল, অতঃপর তার স্বামীকে জাগ্রত করল, যদি সে উঠতে না চায় তার চেহারায় পানির ছিটা দিল।

নাসাঈ, হাদীস নং ১৬১০; ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৩৬

আবু সাঈদ ও আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

যখন ব্যক্তি ঘুম থেকে উঠে ও তার স্ত্রীকে জাগ্রত করে, অতঃপর উভয়ে সালাত আদায় করে, তাদেরকে অধিক যিকরকারী নারী ও অধিক যিকরকারী পুরুষদের অন্তর্ভুক্ত লেখা হয়।

ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ১৩৩৫; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৩০৯

নবী পত্নী উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম থেকে ঘাবড়ে ওঠেন, অতঃপর তিনি বলেন,

সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ কত খাজানা নাযিল করেছেন? কত ফিতনা নাযিল করা হয়েছে? হে ইউসুফের সাথীগণ (তার স্ত্রীগণ উদ্দেশ্য) তোমরা সালাত আদায়ের জন্য জাগ্রত হও। দুনিয়াতে অনেক পোশাক পরিহিতা আখিরাতে নগ্ন থাকবে। অপর বর্ণনায় এসেছে: আজ রাতে কী নাযিল করা হয়েছে?

সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১১৫, ১১২৬, ২৬১৮, ৭০৭৯

৮. মনোযোগ ও বুঝে বুঝে যে পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করা যায়, তাহাজ্জুদে সে পরিমাণ পাঠ করা

এক পারা বা তার চেয়ে অধিক বা তার চেয়ে কম উচ্চ-অনুচ্চ যেভাবে ইচ্ছা পড়ার অনুমতি রয়েছে; হ্যাঁ যদি উচ্চ স্বরে তিলাওয়াত করলে পড়াতে প্রাণ আসে অথবা উপস্থিত লোকেরা শ্রবণ করতে পারে, অথবা অন্য কোনো ফায়দা রয়েছে, তাহলে উচ্চ স্বরে পড়া উত্তম। আর যদি নিকটে কেউ তাহাজ্জুদ পড়ে, অথবা তার উচ্চ স্বরের কারণে কারাে কষ্ট হয়, তাহলে আস্তে পড়া উত্তম। আর যদি অগ্রাধিকারের কোনো কারণ না থাকে, তাহলে যেভাবে ইচ্ছা পড়বে।

উপরে বর্ণিত সব অবস্থা সম্পর্কে হাদীস রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোন এক রাতে সালাত আদায় করেছি, তিনি এত লম্বা করলেন যে আমি খারাপ ইচ্ছা করে ছিলাম, বলা হল: কি ইচ্ছা করে ছিলেন? তিনি বললেন: আমি ইচ্ছা করে ছিলাম তাকে ত্যাগ করে আমি বসে যাব।

সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১১৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৭৭৩

Share the Post

Rate the Post

Rating Summary

0.0
0.0 out of 5 stars (based on 0 reviews)
Excellent0%
Very good0%
Average0%
Poor0%
Terrible0%

Latest Reviews

There are no reviews yet. Be the first one to write one.

Latest Book

Scroll to Top